চট্টগ্রামে ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখার লকার থেকে গ্রাহকের এক কোটি ৭৪ লাখ টাকা মূল্যের ১৪৯ ভরি সোনা গায়েবের ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এই নিয়ে ব্যাংকটির শীর্ষ কর্মকর্তার দাবি, গ্রাহক মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছেন। লকার থেকে সোনা চুরি, ডাকাতি কিংবা গায়েব হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদিও এর কোনোটি হয়ে থাকে এর বিনিময়ে তবে গ্রাহক ইন্স্যুরেন্স অনুযায়ী দুই লাখ টাকা পাবেন।
তবে গ্রাহকের অভিযোগ, ব্যাংকের কর্মকর্তা/কর্মচারীরাই এ স্বর্ণ গায়েবের সঙ্গে জড়িত। তিনি স্বর্ণ উদ্ধারের পাশাপাশি এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন।
এদিকে, লকার থেকে স্বর্ণ গায়েবের খবরে রোববার (২ জুন) সকাল থেকে ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখায় ভিড় করেন গ্রাহকরা। যেসব গ্রাহক এই শাখায় লকার ব্যবহার করেন তাদের মূল্যবান জিনিসপত্র রক্ষিত আছে কি না তা খতিয়ে দেখেন।
ইসলামী ব্যাংক চকবাজার শাখার ম্যানেজার এস এম শফিকুল মাওলা চৌধুরী বলেন, গত ২৯ মে (বুধবার) রোকেয়া আক্তার বারী নামে আমাদের এক গ্রাহক তার লকার চেক করার পর অভিযোগ করেন, তার লকারে রাখা জিনিসপত্র ঠিকমতো পাননি। এরপর গ্রাহক মৌখিকভাবে অভিযোগ করেন, লকার থেকে ১৫০ ভরি স্বর্ণ মিসিং (নাই) হয়েছে। গ্রাহককে বলেছি, এ বিষয়ে আমাদের কিছুই করার নেই। গ্রাহক কী রেখেছেন তা গ্রাহক ভালো জানেন। আমার মনে হচ্ছে, স্বর্ণ মিসিং সংক্রান্ত অভিযোগটি মিথ্যা। লকার থেকে স্বর্ণ চুরি, ডাকাতি কিংবা গায়েব হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। লকারে গ্রাহক কী রাখছেন তা জানার আমাদের সুযোগ নেই।
তিনি আরও বলেন, তবে লকারে দাহ্য পদার্থ ও আগ্নেয়াস্ত্র না রাখার বিষয়ে আমরা ডিক্লারেশন নিয়ে থাকি। অন্য জিনিসের বিষয়ে ডিক্লারেশন নেওয়ার নিয়ম নেই। লকার সংক্রান্ত বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সব সার্কুলার মেনেই আমাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি।
ব্যাংকটির এই কর্মকর্তা বলেন, লকারের পর্যাপ্ত সিকিউরিটি আমরা নিয়ে থাকি। গ্রাহক যে লকার ব্যবহার করেন তার একটি চাবি গ্রাহকের কাছেই গচ্ছিত থাকে। আরেকটি চাবি লকার ম্যানেজারের কাছে রক্ষিত থাকে। ওই মাস্টার চাবি দিয়ে সব লকার খোলা যায়। এরপরও গ্রাহকের মৌখিক অভিযোগের বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছি। ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
যদি গ্রাহক রোকেয়া আক্তার বারীর অভিযোগ সঠিক হয়, অর্থাৎ ব্যাংকের লকার থেকে যদি স্বর্ণালংকার গায়েব বা উধাও হওয়ার ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে তিনি ক্ষতিপূরণ পাবেন কি না?- এমন প্রশ্নে ব্যাংক ম্যানেজার এস এম শফিকুল মাওলা চৌধুরী বলেন, প্রত্যেক লকার ব্যবহারকারীর ইন্স্যুরেন্স করা আছে। এখানে তিন ধরনের লকার আছে। ছোট, মাঝারি ও বড়। এর মধ্যে ইন্স্যুরেন্স অনুযায়ী ছোট লকার ব্যবহারকারীরা এক লাখ টাকা, মাঝারি লকার ব্যবহারকারীরা দুই লাখ টাকা ও বড় লকার ব্যবহারকারীরা তিন লাখ টাকা করে ইন্স্যুরেন্স থেকে পাবেন। গ্রাহক রোকেয়া মাঝারি আকারের লকার ব্যবহার করেন। তিনি দুই লাখ টাকা ইন্স্যুরেন্স সুবিধা পাবেন।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংক চকবাজার কাপাসগোলা শাখার ম্যানেজার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, কোনো গ্রাহক স্বর্ণালংকার বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ কিছু রাখার জন্য ব্যাংকের লকার ব্যবহার করে থাকেন। লকার ব্যবহারে গ্রাহকের সঙ্গে যে চুক্তি হয় সেখানে দাহ্য পদার্থ বা আগ্নেয়াস্ত্র রাখবে না উল্লেখ থাকে। চুক্তি মেনে লকার ব্যবহারকারী গ্রাহক সেখানে কী রাখেন তা গ্রাহকের একান্ত মর্জি। লকারে স্বর্ণ, জমির দলিলপত্র নাকি অন্য কিছু রাখছেন তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানেন না। ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে তাও বাধ্য নন গ্রাহক। আবার গ্রাহক কী রাখছেন তা জানাতে হবে সে সম্পর্কে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের বাধ্যবাধকতা নেই। লকারের দুটি চাবি থাকে। একটি থাকে গ্রাহকের কাছে অপর চাবি থাকে লকার ম্যানেজারের কাছে। তবে লকারে রাখা আমানত খোয়া গেলে ইন্স্যুরেন্স বাবদ কত টাকা পাবেন তা আমার জানা নেই।
এ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ডক্টর জায়েদ বখত বলেন, ব্যাংকের স্বর্ণালংকার রাখলে সেটি চুরি বা ডাকাতি হলে সাধারণত ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দায় নিতে চায় না। তবে স্বর্ণালংকারের ইন্স্যুরেন্স করা থাকলে সেই অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ পেতে পারে।
ভুক্তভোগী রোকেয়া আক্তার বারী বলেন, আমার পারিবারিক স্বর্ণালংকার নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকের লকারে রেখেছি। এখানে ১৬০ ভরি স্বর্ণালংকার ছিল। এ স্বর্ণগুলো আমার দুই ছেলের স্ত্রী, আমার মেয়ে ও আমার নিজের ছিল। এর মধ্যে ১৫০ ভরির মতো গায়ের হয়েছে। লকারে ছিল মাত্র ১০ থেকে ১১ ভরির মতো স্বর্ণ। এগুলো গায়েব হওয়ার পেছনে ব্যাংক কর্মকর্তারাই দায়ী। লকারের চাবি আমারটা আমার কাছে থাকে। আরেকটা ব্যাংক কর্তৃপক্ষের কাছে থাকে। আমি লকারটা খোলা অবস্থায় পেয়েছি।
তিনি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত ২৯ মে দুপুরে আমি চকবাজার ইসলামী ব্যাংকের শাখায় যাই। বেশ কয়েক বছর ধরে আমি এ শাখায় লকার ব্যবহার করে আসছি। লকার ম্যানেজারকে বলি, আমার লকার খুলব। কিছু জিনিস রাখব, কিছু নেব। প্রথমে লকার ম্যানেজার ভেতরে ঢোকেন।
তিনি জিজ্ঞেস করেন, আমার লকার নম্বর কত? জানাই, ৪৪। তখন লকার ম্যানেজার বলেন, আপনার লকার তো খোলা। আমিও সামনে গিয়ে দেখি খোলা। এমন অবস্থা দেখে আমার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি লকারে হাত ঢুকিয়ে দেখি যেসব বাক্স ছিল অধিকাংশই নেই। ৭-৮টি বাক্স পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুটিতে অল্প পরিমাণ স্বর্ণ পাওয়া গেছে। যার পরিমাণ ১০ থেকে ১১ ভরি হতে পারে। সেদিন ব্যাংকের ম্যানেজার ছুটিতে ছিলেন। আমার চিৎকার শুনে ব্যাংকের সেকেন্ড, থার্ড অফিসারসহ অন্যরা দৌড়ে আসেন। আমি বললাম, আমার স্বর্ণ কোথায় গেছে আপনারা বের করে দেন। তখন কর্মকর্তারা বলেন, আমরা কোথা থেকে দেব? আমি বলেছি যদি লকারের জিনিসপত্রের নিরাপত্তা দিতে না পারেন তাহলে আমার জিনিস রেখেছেন কেন? আমি আমার স্বর্ণ ফেরত চাই।
চট্টগ্রামের চকবাজার শাখার এই গ্রাহক বলেন, বাসায় অনিরাপদ মনে করে, লকার ভাড়া নিয়ে এসব স্বর্ণ রেখেছি শুধু নিরাপত্তার জন্য। এখন লকার থেকে গায়েব হওয়ার ঘটনা আমাদের সত্যি মর্মাহত করেছে। ব্যাংকের প্রতি আস্থার সংকট সৃষ্টি করেছে।
ওই নারীর ছেলে রিয়াদ মোহাম্মদ মারজুক বলেন, ব্যাংকের লকার থেকে স্বর্ণালংকার গায়েব হওয়ার ঘটনা আশ্চর্যজনক। মানুষ নিরাপত্তার জন্য ব্যাংকের লকারে জিনিসপত্র রাখেন। এখন দেখছি, ব্যাংকের লকার থেকেও স্বর্ণ গায়েব হয়েছে। আমাদের গায়েব হওয়া স্বর্ণ ফেরত চাচ্ছি। এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার দাবি জানাচ্ছি। এ ঘটনায় আমার পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে মামলা করা হবে।
চকবাজার থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন আকবর বলেন, ‘বিষয়টি ২৯ মে আমাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছিলেন স্বর্ণের মালিক। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। তবে এখন পর্যন্ত ব্যাংকের লোকজন কিংবা ভুক্তভোগী থানায় মামলা করতে আসেননি। অভিযোগ পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চট্টগ্রামের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, ব্যাংকের লকারে যখন কোনো জিনিস রাখা হয় তখন সেটি ওজন করে রাখা হয় কিনা কিংবা লকারে কী রাখা হয়েছে এবং লকার থেকে ব্যবহারকারী কী নিয়ে যাচ্ছেন তা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এন্ট্রি রাখেন কিনা তা আমার জানা নেই। ব্যাংককে নিরাপদ মনে করেন বিধায় মানুষ লকারে স্বর্ণালংকার, টাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র রাখেন। মানুষ টাকা দিয়ে ব্যাংকে কিংবা লকারে রাখেন- যাতে তার জিনিসগুলো নিরাপদে থাকে। গ্রাহকের ১৫০ ভরি স্বর্ণ গায়েব হওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক। এখন মানুষের বিশ্বাস, ভরসা ও নিরাপত্তার জায়গা আর নিরাপদ থাকল না। ব্যাংকের উচিত এর সত্যতা উদঘাটন করা। এর সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা। এমনকি ব্যাংকের সুনাম ঐতিহ্যের স্বার্থে এ ঘটনা উদঘাটন করা জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে দেখা।