এক জীবনে মানুষের বসবাসের জন্য খুব বেশি জায়গা-জমি বা ফ্ল্যাটের দরকার নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তিতে বসবাসের জন্য যেটুকু প্রয়োজন, তা-ই আপনারা করবেন।’ পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থাকাকালে বাহিনীর নবীন সদস্যদের উদ্দেশে এভাবেই বলতেন বেনজীর আহমেদ। অবসরে যাওয়ার পর তাঁর নিজের ও পরিবারের সদস্যদের শত শত বিঘা জমি এবং বিপুল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এসব সম্পদের বেশ কিছু তিনি করেছেন পুলিশের শীর্ষ পদে থাকাকালে।
দেশের অন্তত সাত জেলায় বেনজীর পরিবারের জমি থাকার তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। স্বাস্থ্যের ঠিকাদার মোতাজজেরুল ইসলাম মিঠুর সঙ্গেও তাঁর ব্যবসায়িক অংশীদারির কথা সামনে আসছে। তবে এই অংশীদারিত্ব ‘কাগজে-কলমে’ নাকি মৌখিক, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
বছর আটেক আগে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার রণচণ্ডী ও চাঁদখানা ইউনিয়নে কৃষকদের বিঘা বিঘা জমি জোরপূর্বক কিনতে গেলে বাধার মুখে পড়েন মিঠু। তীব্র প্রতিবাদ জানান কৃষকরা। এর পর হঠাৎ একদিন বেনজীরকে নিয়ে হেলিকপ্টারে মিঠু ওই এলাকায় হাজির হন। বেনজীর তখন ছিলেন র্যাব মহাপরিচালক। মিঠুর সঙ্গে বেনজীরকে দেখে এলাকায় এক ধরনের আতঙ্ক তৈরি হয়। পরে প্রতিবাদ কর্মসূচি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেন অনেক কৃষক। তখন নামমাত্র দামে কৃষকের জমি কিনে সীমানা প্রাচীর দেন মিঠু। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আবেদনে আদালত বেনজীরের সম্পদ জব্দের আদেশ দেওয়ার পর পুরোনো সেই ঘটনা সম্পর্কে অনেকে মুখ খুলছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রণচণ্ডী ও চাঁদখানার সেই জায়গায় মিঠুর পোলট্রি খামার ও ভুট্টা বেচাকেনার ব্যবসা চলছে। এসব দেখভাল করছেন তাঁর ছোট ভাই মানিক হাজি। এলাকার অনেকে জানান, মিঠুর এই ব্যবসার অংশীদার বেনজীর। রণচণ্ডী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান বিমান সমকালকে বলেন, ‘২০১৬ সালের দিকে মিঠু বিঘা বিঘা জমি জোরপূর্বক কিনতে শুরু করেন। কিন্তু অনেক কৃষক জমি বিক্রি করতে রাজি হচ্ছিলেন না। তারা একত্র হয়ে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। হঠাৎ একদিন হেলিকপ্টারে বেনজীর আহমেদকে নিয়ে এলাকায় আসেন মিঠু। যে জমি নিয়ে ঝামেলা চলছিল, সেখানে ২০ মিনিটের মতো তারা হাঁটাহাঁটি করেন। এর পর জানলাম, মিঠুর সঙ্গে এই ব্যবসায় বেনজীর আছেন।
মোখলেছুর আরও বলেন, ‘বেনজীর চলে যাওয়ার পর মিঠু জমিজমার সমস্যা সমাধানে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বসেন।
বৈঠকে তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান, ইউপি চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের লোকজন ছিলেন। তবে কোনো সুরাহা হয়নি। তারা যেভাবে পেরেছেন, সেভাবে জমি দখলে নিয়েছেন। আর ওসিসহ প্রশাসনের যারা গ্রামবাসীর পক্ষে ছিলেন, তাদের রাতারাতি বদলি করা হয়েছে।’ যে জমিতে এখন ভুট্টা কেনাবেচা চলছে, ঠিকাদার মিঠু সেখানে জুট মিল করতে চেয়েছিলেন বলে জানান তিনি। কিশোরগঞ্জের তৎকালীন উপজেলা চেয়ারম্যান রশিদুল ইসলাম জানান, জমিজমার ঝামেলা নিরসনে তিনি তখন কয়েক দফা বৈঠকে বসেছিলেন।
এ বিষয়ে বেনজীর আহমেদ ও মিঠুকে একাধিকবার ফোন করে পাওয়া যায়নি। দুদক দুর্নীতির মামলা করার পর মিঠু দেশের বাইরে পলাতক। আর বেনজীর আহমেদ সপরিবারে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন বলে জানা যায়।
দুদকের অনুসন্ধানে বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে এখন পর্যন্ত ৬২১ বিঘা জমির খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৫৯৮ বিঘা গোপালগঞ্জ সদর ও মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলায়। এ ছাড়া বান্দরবান, কক্সবাজার, গাজীপুর, সাতক্ষীরায় ও ঢাকায় নামে-বেনামে বেনজীরের সম্পদ থাকার তথ্য সামনে আসছে। বান্দরবান সদরের সুয়ালক এলাকায় ২৫ একর জায়গায় রয়েছে মৎস্য ও গরুর খামার এবং বাংলো। লামার ডলুছড়িতেও রয়েছে ফলদ-বনজ বাগান ও বাংলো। স্থানীয়দের কাছে জায়গাগুলো ‘আইজিপির জমি’ নামে পরিচিত। এ ছাড়া সেন্টমার্টিনে বেনজীরের নামে ১ একর ৭৫ শতাংশ জমি রয়েছে বলে জানা যায়। কক্সবাজার মেরিন ড্রাইভের ইনানী সৈকতে বেনজীর তাঁর স্ত্রী ও তিন মেয়ের নামে কেনেন আরও ৭২ শতক জমি। এসব জমির বর্তমান বাজারমূল্য অন্তত ২৫ কোটি টাকা।
ডলুছড়ির টংগাঝিরি এলাকার অজিত ত্রিপুরা বলেন, ‘অভাবের কারণে বাবা আমাদের পাঁচ একর জায়গা বেনজীর নামে এক পুলিশ কর্তার কাছে বিক্রি করেছেন। আরও অনেকে নামমাত্র দামে জায়গা বিক্রি করেছেন।’
উখিয়ার পালং ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ছোঁয়ানখালী এলাকায় জীশান মীর্জার জমি ছিল। বেনজীর অবসরে যাওয়ার পর স্থানীয় মোহাম্মদ ছালামত উল্লাহর কাছে সেই জমি বিক্রি করেন জীশান। ওই জমি কেনার বিষয়টি নিশ্চিত করে কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়ারছড়া এলাকার নুরুল হকের ছেলে ছালামত বলেন, ‘সাবেক আইজিপি বেনজীরের স্ত্রীর কাছ থেকে জমিটি কিনে নিয়েছি। আমার নামে খতিয়ানও হয়ে গেছে।’
কক্সবাজার শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে ছোঁয়ানখালী গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৬০টি আরসিসি পিলার দিয়ে ৪৩ শতাংশের কিছু বেশি জমি ঘিরে রাখা হয়েছে। পিলারে লেখা, ‘ক্রয়সূত্রে জমির মালিক ছালামত উল্লাহ।’ ইনানীতে বেনজীরের জমি দেখভালের দায়িত্বে থাকা কলিম উল্লাহ সমকালকে বলেন, ‘বেনজীর স্যার অবসরে যাওয়ার পর পরই জমিটি বিক্রি করে দিয়েছেন।’ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়ে গিয়ে কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালের ২০ ডিসেম্বর জীশান মীর্জা ৮০ লাখ টাকায় জমিটি বিক্রি করে দিয়েছেন।
ভূমি অফিস সূত্রে জানা যায়, মেরিন ড্রাইভের পাশে উখিয়ার ইনানী মৌজায় জীশান মীর্জার নামে ৫৬৯১ নম্বর বিএস খতিয়ানে ০.০৭৩৩ একর, ৫২৮১ নম্বর বিএস খতিয়ানে ০.১৮০০ একর এবং বেনজীরের তিন মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর, তাহসিন রাইশা বিনতে বেনজীর ও জাহরা জারিন বিনতে বেনজীরের নামে ০.১৫০০ একর জমি রয়েছে।
সেন্টমার্টিনের জিনজিরা দ্বীপে মৌজার ১০৩০ নম্বর খতিয়ানের ১৭৮৬ দাগে ৮.২৫ শতাংশ, একই দাগে ১৪.১৪ শতাংশ, ৪৫ শতাংশ, ৩৫ শতাংশ ও ৪০ শতাংশ জমি রয়েছে বেনজীরের নামে। এ ছাড়া ১৭২৫ দাগে আছে ২২ শতাংশ জমি। জমির নামজারিতে মালিকের নাম দেওয়া হয়েছে হারুনুর রশিদের ছেলে বেনজীর আহমেদ; ঠিকানা– গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা, হোল্ডিং নম্বর– ১৬৬। জমিটির বিক্রেতা ছিলেন স্থানীয় মৌলভী আবদুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। খতিয়ানটি সত্যায়ন করেছেন কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা সহকারী ভূমি কমিশনার জাহিদ ইকবাল ও উপজেলা ভূমি অফিসের কানুনগো মো. মুসা। খতিয়ান অনুযায়ী, বেনজীর আহমেদের মালিকানাধীন মোট জমির পরিমাণ ১ একর ৬৮ দশমিক ২৫ শতাংশ। এই জমির সীমানা রক্ষায় কোরাল পাথর তুলে এনে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি কংক্রিটের পিলার দেওয়া হয়েছে জমির চারদিকে। বানানো হয়েছে বড় একটি গেট।
টেকনাফ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) সৈয়দ সাফফাত আলী বলেন, ‘বেনজীর আহমেদ ২০১৫ সালে দ্বীপে জমি কেনেন। জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়েছিলেন কিনা সেটি এই মুহূর্তে বলা মুশকিল। তবে বতর্মানে দ্বীপে জেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া জমি বেচাকেনা বন্ধ রয়েছে।’