সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার ‘মিশন সাকসেস’ হলে টাকা দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টু। এ বিষয়ে তিনি ওই হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র ও মিন্টুর বিষয়ে আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। এদিকে মিন্টুর ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর হলেও সেই মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গত ১৬ জুন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
তদন্ত সংস্থা ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা (ডিবি) বিভাগ থেকে আদালতে পাঠানো প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, গত ৫ অথবা ৬ মে হোয়াটসঅ্যাপে আক্তারুজ্জামান শাহীন কথা বলেন সাইদুল করিম মিন্টুর সঙ্গে। সেই কথোপকথনে এমপি আনার হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সাপেক্ষে আর্থিক লেনদেনের কথা বলা হয়। গ্রেপ্তার অন্য আসামি কামাল আহমেদ বাবু হত্যাকাণ্ডের পর মূল কিলার শিমুল ভূঁইয়ার (আমানুল্লাহ) সঙ্গে সেই প্রতিশ্রুত টাকা লেনদেনের বিষয়ে ডিজিটালি ও ফিজিক্যালি বিস্তারিত আলোচনা করেন। পাশাপাশি এমপি আনারকে অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রমাণস্বরূপ ছবি
আদান-প্রদান করেছেন। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব তথ্য ঘাতক দলের প্রধান শিমুল ভূঁইয়া ও মিন্টুর ঘনিষ্ঠ সহচর অপর আসামি কাজী কামাল আহমেদ বাবুর স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও উঠে এসেছে। বাবু ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক।
পুলিশ প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রধান কিলার শিমুল ভূঁইয়ার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সাইদুল করিম মিন্টুর সংশ্লিষ্টতা বেরিয়ে আসে। তাতে এমপি আনারকে প্রলুব্ধ করে অপহরণ ও হত্যা সংশ্লিষ্টতার সঙ্গে আর্থিক লেনদেনে মিন্টুর সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে জানা যায়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবি সূত্র জানায়, অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের পর সাইদুল করিম মিন্টুর কাছে শিমুল ভূঁইয়ার দাবি করা টাকার আংশিক বাবুর মাধ্যমে ২৩ মে পরিশোধ করার কথা ছিল।
ঝিনাইদহ-৪ আসনে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ছিলেন আনোয়ারুল আজিম আনার। গত ১২ মে তিনি চিকিৎসার কথা বলে ভারতে যান। এরপর থেকে তার সন্ধান মিলছিল না। ওই ঘটনায় কলকাতায় সাধারণ ডায়েরি করেন তার বন্ধু। তাকে খোঁজাখুঁজির মধ্যেই ২২ মে ঢাকার ডিবি পুলিশ নিশ্চিত হয়, আনারকে কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন্সের একটি ফ্ল্যাটে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছে। তার দেহ কেটে টুকরো টুকরো করে গুম করা হয়। পরে আনারের মেয়ে ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেন। ওই মামলায় ঢাকার গোয়েন্দারা প্রধান কিলার শিমুল ভূঁইয়া, তার ভাতিজা তানভীর ভূঁইয়া ও পলাতক শাহীনের বান্ধবী শিলাস্তি রহমানকে গ্রেপ্তার করে। তাদের রিমান্ডে নিলে হত্যা পরিকল্পনা, মিশন বাস্তবায়ন থেকে শুরু করে লাশ গুমের বিষয়ে তথ্য দেন তারা। তদন্তের এক পর্যায়ে ডিবি পুলিশ ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক বাবু ও পরে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়। তাদের মধ্যে শিমুল ভূঁইয়া, তানভীর, শিলাস্তি ও বাবু আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। মিন্টু কারাগারে রয়েছেন।
এদিকে ৮ দিনের রিমান্ডে নিলেও দুই দিনের মাথায় তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। এ নিয়ে ঝিনাইদহে মিন্টুর
পক্ষে-বিপক্ষে নানা ধরনের গুঞ্জন শুরু হয়েছে। তবে ঢাকায় দায়ের হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সহকারী কমিশনার মাহফুজুর রহমান কালবেলাকে বলেন, হত্যায় সরাসরি জড়িত আসামিদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে সাইদুল করিম মিন্টুর সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়। তা ছাড়া কাজী কামাল আহমেদ বাবু নামে আরেক আসামির ভাষ্যেও মিন্টুর নাম আসে। এসব তথ্য যাচাই করতেই তাকে রিমান্ডে আনা হয়েছে। আপাতত সেই যাচাই শেষ হওয়ায় তাকে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। এখন তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।
তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, আসামি সাইদুল করিম মিন্টুকে আদালতে সোপর্দ করার প্রতিবেদনেই উল্লেখ করা হয়েছে মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আসামিকে ফের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হতে পারে। এজন্য মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত ওই আসামিকে কারাগারে আটক করার আবেদন করা হয়েছে।
বিচার নিশ্চিতের দাবিতে ঝিনাইদহে মানববন্ধন
কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ) প্রতিনিধি জানান, এমপি আনার হত্যার বিচার নিশ্চিত করতে গতকাল কালীগঞ্জে মানববন্ধন হয়েছে। উপজেলার রাখালগাছী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ আয়োজনে ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের রঘুনাথপুর বাজারে এ মানববন্ধন হয়। ওই কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে এমপি আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেন, আমি আমার বাবার হত্যার বিচার সুনিশ্চিত করতে চাই এবং যারা এই জঘন্যতম অপরাধটি করেছে তাদের সর্বোচ্চ বিচার চাই। এর জন্য যা যা করণীয়, আমি আমার বাবার জন্য একজন সন্তান হিসেবে, একজন মেয়ে হিসেবে সবকিছু করব। তিনি বলেন, আমার বাবার হত্যার বিচার করতেই হবে। কালীগঞ্জের মানুষ দেখবে, আমার বাবার হত্যার বিচার হয়েছে।
কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুর ইসলাম আশরাফ বলেন, এমপি আনার হত্যার সঙ্গে জড়িত অনেকে এখন পুলিশের তদন্তের ধরা পড়ছে। যারা এখনো শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হয়নি, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় নিতে হবে।
মানববন্ধনে কালীগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর সিদ্দিকী ঠান্ডু, উপজেলা চেয়ারম্যান শিবলী নোমানী, সাবেক উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান রাশেদ শমসের, রাখালগাছী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিদুল ইসলাম মন্টুসহ অন্যরা বক্তব্য দেন।