24 C
Dhaka
Thursday, November 21, 2024

পদ্মার চরে রাসেল ভাইপার আতঙ্ক, বাদাম তুলতে মিলছে না শ্রমিক

ফরিদপুরের সদরপুর পদ্মার চরাঞ্চলে আতঙ্কের নতুন নাম ‘রাসেল ভাইপার’। এ সাপের ভয়ে বাদাম তোলার জন্য কোনো শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। বাধ্য হয়ে জীবনের মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে জমির মালিকরাই বাদাম তুলছেন।

বৃহস্পতিবার (২০ জুন) সকালে সদরপুর উপজেলার দিয়াড়া নারিকেল বাড়িয়া ইউনিয়নের পদ্মার চরাঞ্চলে গিয়ে দেখা যায়, জেগে উঠা ধু ধু বালুচরে বাদাম তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কিষান-কিষানিরা। ফরিদপুর সদর, চরভদ্রাসন ও সদরপুরের চরাঞ্চলের বেলে মাটি বাদাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। তবে এ বছর প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে ফলন আশানুরূপ হয়নি।

সম্প্রতি পদ্মার পানি বেড়ে গিয়ে বাদাম ক্ষেতে ঢোকায় অপরিপক্ব বাদামও তুলতে হচ্ছে। এতে পুরুষের চেয়ে নারীদেরই বেশি দেখা যায়। প্রথমে ক্ষেত থেকে বাদাম তোলা হচ্ছে, এরপর ক্ষেতেই গাছ থেকে বাদাম কাটা হচ্ছে। তারপর নৌকায় করে নদী পার হয়ে বাদাম নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাড়িতে।

বাদাম চাষি শাহাদাৎ হোসেন জানান, বাদাম লাগানোর সময় ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা মণ দরে বাদাম কিনে লাগাতে হয়েছে। বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। বিঘায় উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল ১০ থেকে ১৫ মণ। কিন্তু এ বছর ফলন হয়েছে ৫ থেকে ৮ মণ। দাম ভালো না পেলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন তারা।

এদিকে, সম্প্রতি চরাঞ্চলে রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বেশি হওয়ায় ভয়ে অনেকেই ক্ষেতে যাচ্ছেন না। বাদাম তুলতে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে জমির মালিকরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্ষেতে নেমে পড়ছেন।

আরও পড়ুনঃ  কোটা আন্দোলন এত দিন যা যা ঘটেছে

বাদাম চাষি আব্দুল ছালাম বলেন, সম্প্রতি রাসেল ভাইপারের উপদ্রব বেড়ে গেছে। গত ছয় মাসে সাপের কামড়ে মারা গেছে পাঁচজন। এ কারণে কৃষি শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। ভয়ে কেউ ক্ষেতে নামতে চাইছে না। বাধ্য হয়ে নিজেদেরই বাদাম তুলতে হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, চরাঞ্চলের মানুষের অন্যতম আয়ের উৎস বাদাম চাষাবাদ। এর ওপরই সারা বছরের সংসার খরচ চলে। সে কারণে ঝুঁকি নিয়েই বাদাম তুলতে হচ্ছে।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ক্ষেতে বাদাম তুলতে এসেছেন বিউটি আক্তার। তিনি বলেন, প্রচণ্ড দাবদাহে এমনিতে বাদামের ফলন এ বছর ভালো হয়নি। তার ওপর আবার পদ্মার পানি বাড়ায় ক্ষেতে ঢুকে গেছে। এতে অপরিপক্ব বাদাম তুলে ফেলতে হচ্ছে। এখন যাও পাওয়া যাবে, পানিতে ডুবে গেলে কিছুই পাওয়া যাবে না। তাই স্বামীর সঙ্গে বাদাম তুলতে এসেছি।

তিনি আরও বলেন, সাপের ভয়ে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। অনেককে বলেছি। কিন্তু কেউ রাজি হয়নি। এ কারণে পরিবারের সবাই মিলে বাদাম তুলছি। কী করব, বাদামই আমাদের একমাত্র অবলম্বন। তাও এবার ফলন ভালো না হওয়ায় মন খারাপ। তবে দাম যদি একটু বেশি পাই তাহলে লোকসান হবে না। বাদাম থেকে যা আয় হয়, তা দিয়েই সারা বছর সংসার চলে।

আরও পড়ুনঃ  জনগণ মনে করে ফারুকীর চেয়ে আমি যোগ্য: হিরো আলম

আমিরন নেছা বলেন, আমি মানুষের বাড়িতে গিয়ে কাজ করি। বাদাম তোলার সময় প্রতি বছরই এ কাজ করি। বেতন ভালো পাই। এ বছরও বাদাম তুলতে আইছি, কিন্তু ভয় লাগে সাপের। বাড়িতে কাজ করার চেয়ে বেশি টাকা পাই, তাই আইছি। বয়স হয়েছে, আল্লাহর ওপর ভরসা রেখে আইছি। যদি সাপের কামড়ে মরে যাই যাব, কিন্তু কাজে না এলে খাব কী, চলব কীভাবে! ঘরে বসে থাকলে তো আর কেউ খাবার দেবে না। দুমুঠো খাবারের জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাদাম ক্ষেতে এসেছি।

সদরপুর উপজেলার দিয়াড়া নারিকেল বাড়িয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন বলেন, দাবদাহের কারণে বাদাম এবং তিলের ফলন ভালো হয়নি। পাশাপাশি পদ্মার পানি বাড়ায় তীরবর্তী এলাকার বাদাম ক্ষেতে পানি ঢুকেছে। তাড়াহুড়ো করেই বাদাম তুলে ফেলতে হচ্ছে চাষিদের। এ ছাড়া আরেকটি বড় সমস্যা রাসেল ভাইপারের কারণেও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। চরাঞ্চলের বেশ কয়েকজন সাপের কামড়ে মারা যাওয়ায় অনেকে ভয়ে ক্ষেতে যেতে চাচ্ছে না।

তিনি আরও বলেন, আমি বিভিন্ন কাজে সদরপুরে থাকি প্রায় সময়, কিন্তু আমি নিজে যখন চরাঞ্চলে যাই, তখন নিজেও ভয়ে ভয়ে থাকি। রাসেল ভাইপার এমনিতে দেখা যায় না। হঠাৎ করেই চলে আসে। অন্য সাপ মানুষ দেখলে পালিয়ে যায়। কিন্তু রাসেল ভাইপার মানুষ দেখলে এগিয়ে আসে। আমরাও খুব চিন্তিত। ইউনিয়নব্যাপী রাসেল ভাইপারের বিষয়টি নিয়ে সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছি।

আরও পড়ুনঃ  ভারত কেন শেখ হাসিনাকে রাখতে চায় না?

সদরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ নিটুল রায় বলেন, উপজেলায় এ বছর ৩ হাজার ২৮২ হেক্টর জমিতে বাদামের আবাদ হয়। যা গেল বছরের তুলনায় ১৩০ হেক্টর বেশি।

তিনি আরও বলেন, যারা আগাম বাদাম লাগিয়েছিলেন তাদের তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। তবে পরে যারা বাদাম লাগিয়েছেন পদ্মার পানি বাড়ায় তাদের কিছুটা ক্ষতি হতে পারে। অবশ্য তা হবে খুবই সামান্য। চাষিদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে, বৃষ্টির মধ্যে যাতে বাদাম না তোলে। রোদের মধ্যে বাদাম তুললে কালারটা ভালো থাকবে। এ ছাড়া রাসেল ভাইপার থেকে বাঁচতে কৃষকদের ক্ষেতে মশার কয়েল জ্বালিয়ে কাজ করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কারণ ধোঁয়া সাপের চোখে গেলে সেখান থেকে দ্রুত তারা সরে যায়। কৃষকরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে সফলও হচ্ছে। তা ছাড়া চাষিদের সব ধরনের সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সৈয়দ মুরাদ আলি বলেন, রাসেল ভাইপারের সাপের বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে কাজ শুরু করেছি। ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রথম অবস্থায় চরাঞ্চলে কৃষকদের বিশেষ জুতা (গামবুট) দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ