রাসেলস ভাইপার, যেটি বিভিন্ন অঞ্চলে চন্দ্রবোড়া, উলুবোড়া কিংবা গুলবাহার সাপ নামে পরিচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এই সাপটি পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে পদ্মা ও মেঘনা নদীর তীরবর্তী জেলাগুলোতে এই সাপের বিস্তার ব্যাপক হারে বেড়েছে। এর আগে এদের বিস্তার শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল।
এই সাপের বিস্তার লাভের পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। প্রথমত, এই সাপটির আবাস হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চলের বাইরেও জলবায়ুগত দিক দিয়ে বসবাস উপযোগী বাসস্থান তৈরি হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এইরকম বসবাস উপযোগী স্থান তৈরি হলে সেসব স্থানে প্রাণীটির বিস্তারের পথে কোন ভৌগোলিক বাধা আছে কিনা কিংবা ওই প্রাণীটির শারীরিকভাবে সেসব স্থানে পৌঁছাতে সক্ষম কিনা, সেই বিষয়গুলো বিবেচনায় আসে। আমরা গবেষণায় লক্ষ্য করেছি, রাসেলস ভাইপার আগে শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলে পাওয়া গেলেও বর্তমানে এর বাইরেও জলবায়ুগত কারণে এদের বসবাস উপযোগী স্থান তৈরি হয়েছে। সেসব স্থানের তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত রাসেলস ভাইপারের বসবাস ও বিস্তারের উপযোগী। একই সঙ্গে সেসব স্থানে রাসেলস ভাইপার বিস্তারের পথে যেরকম ভৌগোলিক বাধা থাকা প্রয়োজন, যেমন– বড় পাহাড়, বড় নদী, বিস্তীর্ণ মরু অঞ্চল কিংবা বড় শহর, তন্মধ্যে শুধু বড় নদী রয়েছে, যেটা এর বিস্তারের পথে বাধা হতে পারত। কিন্তু রাসেলস ভাইপার খুব ভালো সাঁতারু হওয়ায় এর দেহকে হালকা কুণ্ডলী করে (অনেকটা ইংরেজি S এর মত) নদীর স্রোতকে ব্যবহার করে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়, এক চর থেকে অন্য চরে ভেসে যাওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। ফলে রাসেলস ভাইপারের জন্য জলবায়ুগত দিক দিয়ে যেসব বসবাস উপযোগী স্থান রয়েছে, সেসব স্থানগুলোতে বিস্তার লাভ করছে।
দ্বিতীয়ত, নতুন স্থানে যাওয়ার পরে রাসেলস ভাইপার বসবাসের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান ও বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে কি? এখন যেহেতু বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে একই বছরে বহু ফসল আবাদ হচ্ছে, সেইসব ফসলি জমিতে প্রচুর ইঁদুর হয়, যা রাসেলস ভাইপারের অন্যতম প্রধান খাবার। তাছাড়া রাসেলস ভাইপার চরাঞ্চলে মাটিতে বাসা করা ছোট ছোট পাখি ও পাখির ডিম খেয়ে থাকে। ফলে যেসব অঞ্চলে রাসেলস ভাইপার বিস্তার লাভ করছে, সেখানে তাদের খাবার ও বাসস্থানের সংকট তৈরি হচ্ছে না।
তৃতীয়ত, যেসব শিকারি প্রাণী রাসেলস ভাইপারকে শিকার করে খায়, সেসব প্রাণীর সংখ্যা দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। বিশেষ করে অবৈধ পাখি শিকার ও কৃষিজমিতে প্রচুর পরিমাণে কীটনাশকের ব্যবহার এর জন্য দায়ী।
একইভাবে যেসব প্রাণীকে আমরা রাসেলস ভাইপারের প্রতিযোগী বলে মনে করি, যারা রাসেলস ভাইপারের মত একইরকম খাবার খায়, তাদের সংখ্যাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে রাসেলস ভাইপারের ভৌগোলিক বিস্তারের পাশাপাশি এর সংখ্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আমরা রাসেলস ভাইপারের দংশন থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য আমাদের কৃষকদেরকে কাজ করার সময় হাতে গ্লাভস ও পায়ে বুট পরার পরামর্শ দিয়ে থাকি। এছাড়াও কোন নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে কাজ করার আগে লাঠি বা কোনকিছু দিয়ে ওই স্থানকে নাড়ানোর জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকি। এরপরেও দুর্ঘটনাবশত রাসেলস ভাইপার দংশন হতে পারে, যা হচ্ছেও।
রাসেলস ভাইপার নিয়ে করণীয় জানাল মন্ত্রণালয়রাসেলস ভাইপার নিয়ে করণীয় জানাল মন্ত্রণালয়
জনসাধারণের মধ্যে একটা ভুল ধারণা আছে, রাসেলস ভাইপার দূর থেকে তেড়ে এসে কামড় দেয়। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। সাধারণত রাসেলস ভাইপার তার নির্দিষ্ট আয়ত্ত, যেখান থেকে সে তার পুরো শরীর এক জায়গায় স্থির রেখে শুধু এর গলাকে যথাসম্ভব লম্বা করে কামড় দেয়। বাংলাদেশের কোন বিষধর সাপই কাউকে দেখে তেড়ে এসে কামড়ায় না।
রাসেলস ভাইপারের দংশনের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে দংশনের স্থানে ব্যথা শুরু হয় ও দংশিত স্থান ফুলে যায়। পরবর্তীতে দংশনের স্থানে পচন ধরে। তাছাড়া দংশনের শিকার ব্যক্তির তলপেটে ব্যথা হতে পারে, বমি হতে পারে, দংশনের স্থান, দাঁতের মাড়ি ও মল-মূত্রের সাথে রক্তপাত হতে পারে।
কেউ যদি রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার হয়, তার প্রথম কাজ হচ্ছে নিকটবর্তী কাউকে অবহিত করা, যিনি দংশনের শিকার ব্যক্তির দেখাশোনা ও পরিচর্যা করতে পারবেন। কোনো দংশন যদি নিশ্চিতভাবে রাসেলস ভাইপারের কারণে হয়ে থাকে, তাহলে দংশনের শিকার ব্যক্তিকে দংশনের স্থানে বা এর আশেপাশে বাঁধ দেয়ার বা গিঁট দেওয়া উচিত নয়। এর ফলে রাসেলস ভাইপারের বিষ হিমোটক্সিন ও মায়োটক্সিন হওয়ার কারণে দংশিত স্থানে পচন ধরায় দংশিত স্থানে বাঁধ বা গিঁট দেওয়ার কারণে অনেক সময় অঙ্গহানি হতে পারে। সেক্ষেত্রে দংশনের শিকার রোগীকে হাতে কামড় দিলে গলার সাথে হাত ঝুলিয়ে রাখা (যেমনটা হাত ভেঙ্গে করা হয়) অথবা পায়ে হলে পা সোজা করে রাখাই শ্রেয়। দংশনের শিকার ব্যক্তি যথাসম্ভব কম নড়াচড়া বা হাঁটাচলা করবে। পরে অন্যরা তাকে কোনো বাহনে করে হাসপাতালে নিতে সহযোগিতা করবে।
রাসেলস ভাইপার সাপে কাটলে যা করবেন, যা করবেন না রাসেলস ভাইপার সাপে কাটলে যা করবেন, যা করবেন না
বাংলাদেশের সব মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ও জেলা হাসপাতালে রাসেলস ভাইপারের বিষ প্রতিরোধী অ্যান্টিভেনম মজুত থাকে। তাই কেউ রাসেলস ভাইপারের দংশনের শিকার ব্যক্তিকে কোন ওঝা, বৈদ্যি বা কবিরাজের কাছে না নিয়ে গিয়ে সরাসরি হাসপাতালে যেতে হবে। তাহলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দংশনের শিকার রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হবে।
ড. মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ চৌধুরী: সহযোগী অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ইব্রাহিম খলিল আল হায়দার: প্রভাষক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়