20 C
Dhaka
Thursday, December 26, 2024

ফ্রান্সের মুসলিমরা যে কারণে ভয় পাচ্ছে

বাইশ বছর বয়সী ফাতিমাতা হঠাৎ করেই যেন অস্তিত্ব সংকটের মধ্যে পড়েছেন। ফরাসি এই তরুণী বলেন, ‘আমার স্বদেশীরাই যেন আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে।’

কেন তাঁর এমন মনে হচ্ছে? যাঁরা বিশ্ব রাজনীতির হালহকিকত সম্পর্কে টুকটাক খবর রাখেন, তাঁরা নিশ্চয় জানেন, গত রোববার ফ্রান্সে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রথম দফা ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে, আর সেই ভোটে উত্থান ঘটেছে অতি ডানপন্থীদের।

ফ্রান্সে অতি ডানপন্থী দলটির নাম ন্যাশনাল র‍্যালি। তার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মারিন লো পেন। আগামী ৭ জুলাই দ্বিতীয় দফার ভোটে লো পেনের দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে কিনা, তা এখনো স্পষ্ট না হলেও বাতাস যেভাবে বইছে, তাতে ডানপন্থীদের জয়েরই পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে।

আর ঠিক এ কারণেই ভীত ফাতিমাতারা। ফ্রান্সে ফাতিমাতার মতো প্রায় ৬০ লাখ মুসলিম রয়েছেন। তাঁরা লো পেনের উত্থান দেখে ভীত হয়ে পড়েছেন।

ফাতিমাতা আল জাজিরাকে বলেন, ‘১৬ লাখ মানুষ এমন একটি দলকে ভোট দিয়েছে, যারা জনপরিসরে বোরখা নিষিদ্ধ করার পক্ষে প্রচার চালিয়েছে। এটি অবিশ্বাস্য। আমার মনে হচ্ছে, ফ্রান্সের মানুষ আমাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।’

ফাতিমাতার বাবা মৌরিতানিয়ার মানুষ এবং মা সেনেগালের। তাঁরা ভাগ্যের অন্বেষণে প্যারিসের উপশহরে আস্তানা গেঁড়েছিলেন। সেখানেই ফাতিমাতার জন্ম ও বেড়ে ওঠা।

আরও পড়ুনঃ  এবার মসজিদে হারাম ও নববিতে ঈদের নামাজ পড়াবেন যারা

ফাতিমাতা জানান, তাঁর মা‑বাবার মতো আরও অনেক জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এই এলাকায় বাস করেন। তাঁরা সবাই এখন নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন।

ফ্রান্সের সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের উৎকণ্ঠার সবচেয়ে বড় কারণ লো পেন। তিনি যদি ফ্রান্সের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হয়েই যান, তাহলে ফ্রান্সের মুসলিমরা বৈষম্যের শিকার হবেন বলে আশঙ্কা করছেন। কারণ, এই লো পেন জনপরিসরে মুসলিমদের হিজাব নিষিদ্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি ফ্রান্সে অভিবাসীদের (মূলত মুসলমান) ঢোকা বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে উৎকণ্ঠায় আাছি

বুথফেরত জরিপ অনুযায়ী, গত রোববারের প্রথম দফার ভোটে প্রায় ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হওয়ার পথে মারিন লো পেন এবং জর্ডান বারডেলার কট্টর ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র‌্যালি (আরএন)। আর প্রায় ২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে দ্বিতীয় হতে পারে বামপন্থী দলগুলোর জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট। মাখোঁর জোট ২০ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ২৩ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় হতে যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘুদের মধ্যে, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে চাপা আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ দেশ ছাড়ার কথা ভাবছেন। যেমন ২৭ বছর বয়সী ইলিয়াস বলেন, ‘আমি ফ্রান্স ত্যাগ করার কথা ভাবছি।’

আরও পড়ুনঃ  কর্মক্ষেত্রে নারীদের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে যা বলল তালেবান

ফ্রান্সে প্রথম দফা ভোটে ভরাডুবি মাখোঁর, এগিয়ে ডানপন্থীরাফ্রান্সে প্রথম দফা ভোটে ভরাডুবি মাখোঁর, এগিয়ে ডানপন্থীরা
চলতি বছরের শুরুর দিকে এক জরিপে দেখা যায়, ইসলামোফোবিয়ার কারণে বহু ফরাসি মুসলিম দেশ ছেড়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতাকে ‘মেধা পাচার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন গবেষকেরা।

আলজেরীয় বংশধর ইলিয়াস বলেন, ‘আমরা যদি সবাই চলে যাই, কে প্রতিরোধ করবে? আমি মনে করি, অন্তত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ফ্রান্সে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।’

ফ্রান্সে বেশির ভাগ মুসলিমই দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী। কিন্তু তাদের ব্যাপারে ডানপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গি সুখকর নয়। তাজিরি নামের এক যুবক বলেন, ন্যাশনাল র‍্যালি বলেছে, ‘তারা দ্বৈত নাগরিকদের ফ্রান্সের “কৌশলগত অবস্থানে” কাজ করতে দেবে না। এটি যদি সত্যি হয়, আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কায় পড়ব। আমি রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করেছি। কিন্তু আমি যদি রাষ্ট্রীয় বিষয়ে কাজ করতে না পারি, তাহলে এ বিষয়ে পড়াশোনা করে কী লাভ হলো?’

তাজিরি বাস করেন দক্ষিণ ফ্রান্সের কার্পেনট্রাস শহরে। সেখানে গত রোবারের নির্বাচনে ৫৩ দশমিক ৫১ শতাংশ ভোট পেয়েছে ন্যাশনাল র‍্যালি।

ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ
ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ। ছবি: রয়টার্স
ন্যাশনাল র‍্যালির আগের নাম ছিল ন্যাশনাল ফ্রন্ট। ১৯৭২ সালে দলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন লো পেনের বাবা জেন মারি লো পেন। দলটি বর্ণবাদী বক্তব্য প্রচার ও ঘৃণা‑বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য পরিচিত।

আরও পড়ুনঃ  তুরস্কে ভিড়ল ইসরায়েলি জাহাজ, চলল গুলি

ফরাসি আইন বিশেষজ্ঞ রিম-সারাহ আলাউয়েন বলেন, ন্যাশনাল র‍্যালির কিছু লক্ষ্য ‘তাত্ত্বিকভাবে সঠিক’ মনে হলেও তা বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। যেমন পাবলিক স্পেসে বোরখা নিষিদ্ধের বিলটি সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা নীতিকে লঙ্ঘন করবে। আবার দ্বৈত নাগরিকত্ব বিলটি সমতার নীতিকে লঙ্ঘন করবে। সুতরাং ন্যাশনাল র‍্যালির পক্ষে ফ্রান্সকে খোলনলচে পাল্টে ফেলা অতটা সহজ হবে না।

তারপরও ন্যাশনাল র‍্যালি যেহেতু একটি রাজনৈতিক দল, সুতরাং তারা ক্ষমতায় এলে ব্যতিক্রমী কিছু ঘটিয়েও ফেলতে পারে বলে মন্তব্য করেন রিম-সারাহ আলাউয়েন। তাঁর মতে, ন্যাশনাল র‍্যালির লক্ষ্যগুলো সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখন দেশের সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠানগুলো কী ভূমিকা রাখে, সেটিই দেখার বিষয়।

তাজিরি বলেন, ‘মাখোঁর শাসনামলেও আমরা ইসলামোফোবিক এবং বর্ণবাদী পরিবেশের মধ্যে বাস করেছি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বলির পাঁঠা হয়েছি আমরা মুসলিমরা ও বিদেশি বংশোদ্ভূত মানুষেরা। সামনের দিনগুলো আমাদের জন্য আরও ভয়ঙ্কর হবে বলে মনে হচ্ছে।’

তথ্যসূত্র: আল জাজিরা, রয়টার্স, এএফপি ও বিবিসি

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ