রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুরে পদ্মা নদীর ধারে বসে অলস সময় কাটাচ্ছিলেন আব্দুর রহমান শিকদার। ৬৬ বছর বয়সী আবদুর রহমান পদ্মা নদীর ভাঙা-গড়ার সাক্ষী। এই ভাঙা-গড়ার খেলায় হেরেছেন অনেকবার। এখন তার শেষ সম্বল ভিটেমাটিটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন পদ্মায়। এক সময়ের ৬০ বিঘা জমির মালিক এই শিকদার এখন অন্যের জমিতে ভাড়া থাকেন। শিকদারের মতো আরও এক হাজার পরিবার জমি ভাড়া নিয়ে থাকেন পদ্মার চরে।
জানা গেছে, পদ্মায় ভাঙনে ভিটেমাটি হারা হয়েছেন চকরাজাপুর ইউনিয়নে ১২শ পরিবারের প্রায় ৬ হাজার মানুষ। তারা বাঘা উপজেলার অন্তর্গত চাকরাজাপুর ইউনিয়নের ৯টির মধ্যে তিন ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তবে এই ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডের তিনভাগের দুইভাগ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বিভিন্ন সময় ভিটেমাটি হারা অধিকাংশ মানুষ আর বসতবাড়ির জন্য জায়গা কিনতে পারেনি। এমন বাস্তবতায় ১ হাজার পরিবার অন্য চরগুলোতে চুক্তিভিত্তিতে জমি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন।
পুরো ইউনিয়নের ২০ হাজার মানুষের বসবাস। এসব মানুষের জীবন-জীবিকার উৎস চরে কৃষিকাজ এবং নদীতে মাছ শিকার করে। নিম্ন আয়ের এসব মানুষের চরে বসতভিটা ছাড়াও কারো কারো শত শত বিঘা কৃষি জমি ছিল। তবে বিভিন্ন সময় নদী ভাঙনে বসতভিটা ও কৃষি জমি বিলীনের ফলে তারা আর অন্য চরে এসে জমি কিনে বাড়ি করতে পারেননি। ফলে এসব মানুষের কেউ কেউ চর ছাড়া হয়েছেন। তবে অনেকের স্থান হয়েছে ভাড়া জমিতে ঘর তুলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন পদ্মার মধ্যে চকরাজাপুর ইউনিয়ন। ইউনিয়নটিতে ১৫টি চর রয়েছে। এই চরে জনসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। উপজেলায় ২৬ কিলোমিটার এলাকা পদ্মা নদী রয়েছে। এর মধ্যে ১৫ কিলোমিটার চকরাজাপুর ইউনিয়নের মধ্যে। পদ্মার মধ্যে এই ইউনিয়নের ৩টি চর নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। এছাড়া ৩টি সরকারি প্রাইমারি স্কুল স্থানান্তর করা হয়েছে অন্য চরে। চকরাজাপুর হাইস্কুল যেকোনো সময়ে পদ্মা গর্ভে চলে যাবে। তবে স্কুলটি রক্ষায় দেওয়া হয়েছে বালুর বস্তা।
এছাড়া ভাঙনে পদ্মা নদীতে বিলীন হয়েছে ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের চকরাজাপুর, ৫ নম্বর ওয়ার্ডের কালিদাসখালী চর, ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চকরাজাপুর চর। এছাড়া আংশিক টিকে আছে ৭ নম্বর ওয়ার্ডের দাদপুর চর, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পলাশি ফতেপুর চর, ৩ নম্বর ওয়ার্ডের চৌমাদিয়া চর, কালিদাশখালির কিছু অংশ। এছাড়া ৮ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মীনগর, ১ নম্বর ওয়ার্ডের আতারপাড়া চর। এসব এলাকার বিদ্যুতের ১৫০টি পোল আগে থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল।
বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই সিলেটে এইচএসসি পরীক্ষা শুরু
আব্দুর রহমান শিকদার জানান, ‘৬৬ বছরের জীবনে বেশ কয়েকবার পেশা বদল করে এখন জেলে। দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে তার (শিকদার) সংসার জীবন। আগে কালিদাসখালী চরের বাসিন্দা থাকলেও এখন চকরাজাপুর গ্রামের বাসিন্দা। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এখন ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে থাকে তিনি। বেশ কয়েকবার পদ্মা নদীতে ভিটেমাটি বিলীন হয়েছে তার। অনেক বার জায়গা পরিবর্তন করে ঘর তুলেছি। সর্বশেষ ২০১৬ সালে নদী ভাঙনের পরে আর পদ্মার চরে জায়গা হয়নি তার।’
তিনি বলেন, ‘সাত বছর ধরে জমি ভাড়া নিয়ে বাড়ি তৈরি করে আছি। চকরাজাপুর চরে ১ বিঘা জমি ভাড়া নেওয়া হয়েছে। সেখানে আমি ও আমার এক ভাইয়ের পরিবারসহ বসবাস করি। দুই ভাইকে জমির ভাড়া বাবদ ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। সেই হিসেবে প্রতি কাঠা ১ হাজার টাকা বছরে ভাড়া। কষ্ট লাগে এক সময় ৬০ বিঘা জমির মালিক ছিলাম। আর এখন মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। তবে নদীর গর্ভে বিলীন হওয়া ওই সব জমির কাগজপত্র এখনও তার কাছে সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু জমি নেই।’
শিকদার আরও বলেন, ‘নিজের ঘরবাড়ি, কৃষি জমি চোখের সামনে নদীগর্ভে বিলীন হতে দেখেছি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু দেখেছি। যতটুকু করার ছিল, তাহলে ঘরবাড়ি অন্য জায়গায় সরিয়ে নেওয়া। তাই করেছি। বেশি কিছু করতে পারিনি। পায়ের নিচে জমি ভেঙে নদী গর্ভে চলে যায়। তখন সেখান থেকে সরে আবার শুরু করি। আবার সেখানেও ভেঙে যায়। কয়েক বছরের মধ্যে এভাবে ৬০ বিঘা জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। চোখের সামনে এগুলো দেখেছি, খুব কষ্ট হয়েছে। রাতারাতি সহায় সম্পদ সব বিলীন হয়ে গেছে।’
শুধু তাই নয়, এই চরে জমি ভাড়া নিয়ে বসবাস করছেন, গৃহিণী উর্মি খাতুন ও গৃহিণী সাইলা আক্তার শিল্পীর মতো ১ হাজারের বেশি পরিবার। তারা জানায়, তিন থেকে চর বছরের চুক্তিতে জমি ভাড়া নেওয়া হয়। তবে এই চুক্তি মৌখিক হয়ে থাকে। কাগজ-কলমে খুব কম চুক্তি হয়। পুরো চরে বছরে ১ হাজার টাকা কাঠা চুক্তিতে জমি ভাড়া পাওয়া যায়। তারা এইভাবে জমি ভাড়া নিয়ে ঘর করে বসবাস করছেন।
এই চরে ১৫ কাঠা জমি অন্য মানুষকে ভাড়া দিয়েছেন আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, অনেকের জায়গা-জমি পদ্মা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। তাদের মধ্যে অনেকেই জমি ভাড়া নিয়ে চরে বসবাস করছেন। বছর চুক্তিতে মানুষ জমি ভাড়া নিয়েছেন।
এ বিষয়ে বাঘার চকরাজাপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ডিএম বাবুল মনোয়ার দেওয়ান বলেন, নদী ভাঙনে চকরাজাপুর ইউনিয়নের ১২০০ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জনসংখ্যার হিসেবে প্রায় ৬ হাজার মানুষ হবে। নদীগর্ভে বিলীনের পরে এসব মানুষ আর জমি কিনে বাড়ি করতে পারেনি। সংখ্যা এমন এক হাজার পরিবার হবে।
বাঘা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তরিকুল ইসলাম বলেন, পদ্মা নদীতে অরক্ষিত বাঁধ। এই কারণে আস্তে আস্তে বাঁধ ভাঙছে। বিভিন্ন সময় অনেকেই ভিটেমাটি হারিয়েছেন। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত এমন ৭০টি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছে।