21 C
Dhaka
Thursday, December 26, 2024

হাসিনার পতনে বাংলাদেশে অনিশ্চিত ভারতের ভবিষ্যৎ

দেশব্যাপী সরকারবিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা গত সোমবার পদত্যাগ করেন। এরপর সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান তিনি।

ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর হাসিনা প্রাথমিকভাবে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির কাছেই হিন্দন বিমান বাহিনী ঘাঁটিতে অবতরণ করেন। সেখানে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল তাকে অভ্যর্থনা জানান।

এখন হাসিনা যদি চান, ভারত সরকার তাকে আশ্রয় দেবে, তাহলে সেটি হবে এমন কিছু যা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটাতে পারে।

বাংলাদেশি মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সিভিল সার্ভিস চাকরিতে সংরক্ষিত কোটার প্রতিক্রিয়ায় কয়েক সপ্তাহ আগে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল; বিক্ষোভ একপর্যায়ে ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং সরকার কঠোরভাবে দমন করে। এরই একপর্যায়ে হাসিনার পদত্যাগের পর মঙ্গলবার সংসদ ভেঙে দেওয়া হয় এবং রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে নিযুক্ত করেন। আকস্মিক এই পট-পরিবর্তন ভারতের উভয় সংকট হিসেবে সামনে এসেছে। ঢাকায় নতুন নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব নিলে দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং বৈদেশিক নীতিতে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে, যা বাণিজ্য, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে।

ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর অজিত দোভাল সোমবারই হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেছেন। আর এই সাক্ষাৎই হাসিনার নেতৃত্বে থাকা বাংলাদেশের সাথে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের তাৎপর্য দেখিয়ে দিচ্ছে। মোদি হাসিনা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ অংশীদারিত্ব গড়ে তুলেছিলেন। হাসিনা ও তার সরকারের অনেক ত্রুটিও উপেক্ষা করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন মোদি, যার মধ্যে স্পষ্ট মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়ও রয়েছে। ভারত বাংলাদেশকে ‘যথেষ্ট অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা’ দিতেও ইচ্ছুক।

আরও পড়ুনঃ  গরুর ট্রাকে বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে নেতা-পুলিশ, ধরা খেয়ে ম্যানেজের চেষ্টা

ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী: ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা লাভের পর বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তবে, সম্পর্ক সবসময় মসৃণ ছিল না— বিশেষত পানি বণ্টনের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের মতো ইস্যুতে ভারতের উদ্বেগের কারণে। ১৯৭০ এবং ১৯৮০ এর দশকে বাংলাদেশে দীর্ঘ সামরিক শাসনে ভারত সন্তুষ্ট ছিল না। ১৯৭৫ সালে রক্তক্ষয়ী সামরিক অভ্যুত্থানে হাসিনার পিতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল, তিনি নয়াদিল্লির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। বাংলাদেশের সামরিক সরকারগুলোও ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল।

হাসিনার পদত্যাগের পর ভারতের এখন দুটি উদ্বেগ রয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশে যে সরকারের অভ্যুদয় হবে তা নিয়ে ভারতকে উদ্বিগ্ন হতে হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের কঠোর ক্র্যাকডাউনের পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দলটি ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতে সক্ষম হবে এমন সম্ভাবনা নেই। হাসিনার আমলে ঢাকার সঙ্গে নয়াদিল্লি যে আরামদায়ক সম্পর্ক উপভোগ করেছিল তা এখন যথেষ্ট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সর্বোত্তমভাবে, ভারত বাংলাদেশের সামরিক সংস্থার সাথে যোগাযোগ করতে পারে এই আশায় যে, তারা দেশে কিছুটা প্রভাব বজায় রাখতে পারে — তবে সামরিক বাহিনী ঐতিহাসিকভাবে নয়াদিল্লিকে যেভাবে দেখেছে তা বিবেচনা করে এটি সহজ কোনও কাজ হবে না। দ্বিতীয়ত, ভবিষ্যৎ সরকার চীনের দিকে ঝুঁকলে ভারত বিশেষভাবে সতর্ক থাকবে।

আরও পড়ুনঃ  আপনি যান গে, এই ক্যাম্পাস আমাদের!

বাংলাদেশ ভারত-চীন প্রতিযোগিতার একটি স্থান হওয়ায় এই দুশ্চিন্তাগুলো বোধগম্য। সাবমেরিন এবং ফাইটার জেটসহ বিভিন্ন ধরনের সামরিক সরঞ্জাম পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ চীনের কাছে ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। নয়াদিল্লির উদ্বেগ বাড়িয়ে ঢাকা সম্প্রতি বেইজিংয়ের সাথে সামরিক মহড়া করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাংলাদেশ যে চীনের সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য প্রস্তুত, এটি সেই ইঙ্গিতই দেয়। উপরন্তু, বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ-এ স্বাক্ষর করেছে। ভারত বাংলাদেশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে সাহায্য করতে ইচ্ছুক হলেও চীনের আর্থিক সম্পদের সাথে কার্যকরভাবে প্রতিযোগিতা করতে পারেনি।

হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনা সম্ভবত এই প্রতিদ্বন্দ্বিতার খোরাক যোগাবে। এর মধ্যে অন্যতম ঘটনা হচ্ছে- প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের বিধবা স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ২০১৮ সাল থেকে দুর্নীতির অভিযোগে কারাগারে ছিলেন। তিনি ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন; তিনি তার মেয়াদে ভারতের প্রতি বিশেষ অনুরাগ দেখাননি এবং বাংলাদেশের ইসলামপন্থি দলগুলোর সাথেও কাজ করেছেন। নয়াদিল্লি তার পরবর্তী পদক্ষেপগুলো সম্পর্কে সতর্ক থাকবে, বিশেষ করে তিনি সামরিক বাহিনীর ঘনিষ্ঠ হতে পারেন।

আরও পড়ুনঃ  আহতদের মধ্য থেকে উপদেষ্টা নিয়োগের দাবির পোস্টটি শেয়ার করলেন সারজিস আলম

এছাড়া মোদির সরকার বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সহিংসতার দিকেও নিবিড়ভাবে নজর রাখবে। মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির কিছু সদস্য অতীতে বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের দুর্দশার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ভারতের সাথে বাংলাদেশের নৈকট্য এবং দুই দেশকে আবদ্ধ করে এমন জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বন্ধন থাকা সত্ত্বেও মোদি সরকার ঢাকায় তার পছন্দের অংশীদার হাসিনার বিরোধীদের শক্তি অনুমান করতে ব্যর্থ হয়েছে।

বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত এখন নিজের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতি উভয়েরই প্রভাবসহ একটি আঞ্চলিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত ভারত সরকারকে ঢাকায় তার প্রভাবের ব্যাপক হ্রাস রোধ করতে হবে।

বিএনপি এবং তার কিছু ইসলামপন্থি মিত্রদের ক্ষমতায় ফিরে আসার সম্ভাবনার মধ্যে চীনও সেখানে পা রাখছে। বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের শক্তি মূলত ভারসাম্যের মধ্যে রয়েছে।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ