23 C
Dhaka
Tuesday, December 10, 2024

ঢাকাকে যে ক্ষোভের কথা জানালো দিল্লি

বাংলাদেশে নাটকীয় পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার বিদায় ও তার দেশত্যাগের পর দেশজুড়ে অস্থিরতার খবর মিডিয়ায় উঠে এসেছে। বিশেষ করে সংখ্যালঘু হিন্দুদের ওপর বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণের ঘটনা ঘটছে এবং হাজারো লোক সীমান্তে এসে ভারতে প্রবেশ করতে চাইছেন এমন তথ্যও পাওয়া যাচ্ছে। এতে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত দিল্লি বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে এবং তাদের ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ করেছে।

দিল্লিতে একাধিক শীর্ষস্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, হিন্দু-বৌদ্ধসহ অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মন্দির-বাড়িঘর-দোকানপাটে হামলা বন্ধ করতে, তাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করতে এবং সর্বোপরি সীমান্ত পেরিয়ে তাদের ভারতে আসার চেষ্টা রোধ করতে যাতে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়– কূটনৈতিক চ্যানেলে গত ৪৮ ঘণ্টায় একাধিকবার সেই অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এই ‘অনুরোধ’ বা বক্তব্য যে সরাসরি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের কাছেই তুলে ধরা হয়েছে, সেই ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে।

দিল্লিতে একটি পদস্থ সূত্রের কথায়, ‘এখনও বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্বই নেয়নি। দেশের আসল নিয়ন্ত্রণ যে সেনাবাহিনীর হাতে, এটা সবাই জানেন– তা কোনও গোপন বিষয় নয়। কাজেই আমরা যা বলার সরাসরি তাদেরই বলছি।’

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে নতুন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিলে ভারত যে সরাসরি তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করবে, তাতেও কোনও সন্দেহ নেই। এটাও ধারণা করা হচ্ছে– অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ড. ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির টেলিফোনে অবশ্যই কথাবার্তা হবে, আর সেখানেও এই প্রসঙ্গটি অবধারিতভাবে উত্থাপিত হবে।

আরও পড়ুনঃ  ডিএনএ টেস্ট থেকে জানলেন তিন সন্তানের বাবা তিনি নন!

এর আগে মঙ্গলবারই (৬ আগস্ট) ভারতের পার্লামেন্টে বিবৃতি দেওয়ার সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর জানিয়েছিলেন, (সোমবার ক্ষমতার নাটকীয় পালাবদলের পর) বাংলাদেশের ‘কর্তৃপক্ষে’র সঙ্গে তাদের যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছে। যা থেকে ধারণা করা হচ্ছে, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দিল্লির সর্বোচ্চ নেতৃত্বের একটা ‘চ্যানেল অব কমিউনিকেশন’ বা যোগাযোগের মাধ্যম খুলে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানানোর জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সেই মাধ্যমটিকেই।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে ভারত কেন এতটা বিচলিত বোধ করছে? এর জবাবে ভারতীয় কর্মকর্তারা যে কারণগুলো তুলে ধরছেন, তা এরকম–

এক) শেখ হাসিনা বিদায় নেওয়ার পর ৭২ ঘণ্টারও বেশি কেটে গেছে, কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি এখনও অস্থিতিশীল। দেশের একটি প্রথম শ্রেণির দৈনিক জানাচ্ছে, শুধু গত তিন দিনেই সারা দেশে আড়াইশ’র মতো প্রাণহানি হয়েছে– যা পুরো কোটা আন্দোলনের সময়জুড়ে যে প্রাণহানি হয়েছে তার প্রায় কাছাকাছি। অবাধে লুটতরাজ, হামলা, ডাকাতি পর্যন্ত চালানো হচ্ছে বলে খবর আসছে, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও অস্তিত্বই বোঝা যাচ্ছে না। যেন দেশে পুলিশ-প্রশাসন বলে কোনও কিছুই নেই। ভারত মনে করছে, আসলে প্রাণহানির সংখ্যা (সোমবার থেকে) এক হাজারের অনেক বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।

দুই) বাংলাদেশের নিজস্ব মিডিয়াতে তো নয়ই– সিএনএন, বিবিসি, আল জাজিরার মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও এই অরাজকতার ছবি সেভাবে তুলে ধরা হচ্ছে না বলে ভারত মনে করছে। ওই কর্মকর্তার কথায়, ‘বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেখলে বা এসব আন্তর্জাতিক চ্যানেল দেখলেও মনে হবে বিচ্ছিন্ন কিছু গন্ডগোল বাদ দিলে বাংলাদেশ যেন নতুন সম্ভাবনার উদ্দীপনায় টগবগ করে ফুটছে। অথচ গ্রাউন্ড থেকে আমরা যে রিপোর্ট পাচ্ছি তা কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন, একটা বড় অংশের সাধারণ মানুষ চরম আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।’

আরও পড়ুনঃ  ১৩০০ বছর ধরে পাথরখণ্ডে আটকে থাকা ‘জাদুর’ তলোয়ার উধাও!

তিন) এসব হামলা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন যারা, তার একটা বড় অংশ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা। সোশ্যাল মিডিয়াতে হিন্দুদের মন্দিরে হামলা বা অগ্নিসংযোগ, তাদের ব্যবসা-দোকানপাট জ্বালিয়ে দেওয়ার অসংখ্য ভিডিও ঘুরছে– যার বেশির ভাগই আসল বলে ভারত মনে করছে। চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, সিলেট, যশোর, বরিশাল, ফেনী, বগুড়া, পঞ্চগড়, ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলা থেকে হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছেন বলে খবর আসছে। আগে থেকে ভারতের ভিসা ছিল বলে হাতেগোনা যে কয়েকজন সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে আসতে পেরেছেন, তাদের কাছ থেকেও ঘটনার বিবরণ পাওয়া যাচ্ছে। গত মঙ্গলবার এস জয়শঙ্করও পার্লামেন্টে জানিয়েছেন যে বহু জায়গায় সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে।

চার) ভারত সীমান্তে বহু জায়গায় শত শত হিন্দু বাংলাদেশি নাগরিক বর্ডার পেরিয়ে ভারতে ঢোকার আশায় কাঁটাতারের বেড়ার আশপাশে জড়ো হয়েছেন। জলপাইগুড়ি জেলায় বেরুবাড়ির কাছে প্রায় হাজারখানেক বাংলাদেশিকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা ফিরিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তারা ভয়ে নিজেদের গ্রামে ফিরতে পারেননি– সীমান্ত থেকে কয়েকশ’ মিটার দূরেই খোলা আকাশের নিচে ও নদীর ধারে অপেক্ষা করছেন। একই ধরনের ছবি দেখা যাচ্ছে দিনাজপুর, যশোর বা সাতক্ষীরা সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায়। সীমান্তবর্তী পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী তো বলেই রেখেছেন, তাদের রাজ্যকে হয়তো বাংলাদেশ থেকে আসা ‘এক কোটি হিন্দু শরণার্থী’কে আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  মার্কিন বিমানবাহী রণতরীতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা!

পাঁচ) সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতের সব দূতাবাস ও কনস্যুলেটের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড স্তব্ধ হয়ে গেছে। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন ও খুলনা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও সিলেটের মিশনগুলো থেকে ভিসা দেওয়ার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। ঢাকায় ভারতের সংস্কৃতিচর্চার প্রধান কেন্দ্র তথা ভারত-বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধ ‘ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার’ হামলাকারীরা ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে, ভবনটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনও দূতাবাসে সরাসরি হামলা চালানো না হলেও ভারতের মিশনগুলোতে কর্মরত প্রায় সব কর্মকর্তা-কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের বুধবার এয়ার ইন্ডিয়া ও ইন্ডিগোর দুটি বিশেষ ফ্লাইটে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। মিশনগুলো দেখাশোনা করার জন্য হাতেগোনা জনাকয়েক কর্মী শুধু বাংলাদেশে রয়ে গিয়েছেন।

ভারতের শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তার কথায়, ‘সার্বিক অবস্থা যখন এরকম, তখন আমাদের আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করার সুযোগ নেই। যখন সে দেশে সরকার দায়িত্ব নেবে, ততক্ষণে আরও অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠতে পারে। ফলে এই মুহূর্তে যাদের হাতে পরিস্থিতির রাশ আছে বলে আমরা মনে করছি, তাদের কাছেই আমরা আমাদের উদ্বেগ ও প্রতিকারের দাবি জানিয়েছি।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ