ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। তার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিয়েছে।
রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তন ও হাসিনার ভারতে আশ্রয়ের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের জ্যেষ্ঠ নেতা ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শশী থারুর। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনাকে সাহায্য না করলে তা হতো ভারতের জন্য অপমানজনক।
এছাড়া বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ নয় বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। সোমবার (১২ আগস্ট) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার ব্যাপক বিক্ষোভের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার পর শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশংসা করেছেন কংগ্রেস নেতা এবং দেশটির এমপি শশী থারুর।
এনডিটিভিকে তিনি বলেছেন, প্রতিবেশী দেশটিতে (বাংলাদেশে) ক্ষমতার পরিবর্তন ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ নয়।
বাংলাদেশের এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তন কীভাবে ভারতের সাথে সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে সে সম্পর্কে তার মতামত জানতে চাইলে থারুর বলেন, ‘আমাদের মৌলিক স্বার্থ বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের মধ্যে নিহিত। আমাদের মৌলিক প্রতিশ্রুতি হচ্ছে— বাংলাদেশের জনগণের মঙ্গল করা। এছাড়া রাষ্ট্রের অবস্থান দ্বিতীয়তে এবং যেকোনও স্বতন্ত্র নেতার অবস্থান তৃতীয় স্থানে।’
শশী থারুর বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের জনগণের সাথে আছি, আমরা ১৯৭১ সালে তাদের সাথে ছিলাম, আমরা সব পরিস্থিতিতে তাদের সাথে ছিলাম। এমনকি যখন তাদের সরকার ছিল যারা আমাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না, আমরা আমাদের সম্পর্ককে সমানভাবে বজায় রাখতে পেরেছি। এবং অবশ্যই ভবিষ্যতে সেই সম্পর্কের কোনও অবনতি হওয়া উচিত নয়।’
নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী এবং গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে তিনি বলেন, এই সরকার নয়াদিল্লির জন্য উদ্বেগের কারণ নয়। তার ভাষায়, ‘আমি মুহাম্মদ ইউনূসকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি, তিনি একজন অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। আমি মনে করি তাকে জামায়াতে ইসলামী বা পাকিস্তানের আইএসআই-এর ঘনিষ্ঠ হিসেবে না দেখে ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ বলে দেখা উচিত। আপনি যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সামগ্রিক গঠনের দিকে তাকান, তাহলে এই অন্তর্বর্তী সরকারের বিষয়ে ভারতের কোনও উদ্বেগ বোধ করার কোনও বিশেষ কারণ নেই বলে মনে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ভারতের জন্য সবচেয়ে বড় উদ্বেগ সর্বদাই ছিল পাকিস্তান ও চীন সমস্যাযুক্ত এই পরিস্থিতিতে কোনও কিছু অর্জন করবে কিনা। তার ভাষায়, ‘এই ধরনের প্রেক্ষাপটে সর্বদা একটি সম্ভাবনা থাকে যে— আন্দোলনের সময় সহিংসতার কিছু আপত্তিকর ঘটনায় পাকিস্তানি আইএসআইয়ের হাত থাকতে পারে, চীনারাও বাংলাদেশে তাদের শক্তিশালী উপস্থিতিকে আরও সম্প্রসারণের সুযোগ হিসাবে দেখতে পারে। উপমহাদেশের মানুষ তাদের এই বিষয়গুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। তবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে বা ড. ইউনূসের প্রাথমিক বিবৃতিতে আমাদের উদ্বেগের কোনও কারণ নেই।’
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ভারতে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার বিষয়ে নরেন্দ্র মোদি সরকারের প্রশংসা করেন শশী থারুর। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি তাকে সাহায্য না করতাম, তাহলে এটা ভারতের জন্য অসম্মানজনক হতো। আমাদের বন্ধুর সাথে খারাপ ব্যবহার করলে কেউ আমাদের বন্ধু হতে চাইত না। শেখ হাসিনা ভারতের বন্ধু এবং ভারত তার বন্ধু। এবং যখন একজন বন্ধু সমস্যায় পড়েছে, আপনি তাদের সাহায্য করার আগে, তাকে সুরক্ষা দেওয়ার বিষয়ে দুবার ভাববেন না। ভারত ঠিক সেটাই করেছে। এটা করার জন্য সরকারকে সাধুবাদ জানাই। সরকার তাকে (হাসিনাকে) এখানে নিয়ে আসার এবং তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সঠিক কাজ করেছে।’
শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানের সময়ের বিষয়ে শশী থারুর বলেন, ‘তিনি কতক্ষণ (ভারতে) থাকতে চান তা আমাদের বিষয় নয়। আপনি কাউকে আপনার বাড়িতে ফোন করবেন না এবং জিজ্ঞাসা করবেন না যে— আপনি কখন চলে যাচ্ছেন। আমার দৃষ্টিভঙ্গি হলো— অপেক্ষা করুন এবং দেখুন, অন্য কোথাও যাওয়ার আগে তিনি এখানে কতক্ষণ থাকতে চান। অন্য কোনও দেশে যাওয়ার আগে বাস্তবিক কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে, ভিসা সংক্রান্ত বিষয় দেখতে হবে। তবে আপাতত, তিনি আমাদের সঙ্গে আছেন এবং আমাদের গর্বিত হওয়া উচিত যে— আমরা এমন সময়ে একজন বন্ধুর পাশে দাঁড়িয়েছি যে সময়টিতে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল।’
সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার বিষয়ে ভারত সরকারের উদ্বেগ নিয়ে প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে পরস্পরবিরোধী প্রতিবেদন আসছে। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই কিছু হামলা হয়েছে, এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, কারোরই অস্বীকার করা উচিত নয়। এটা সত্য। একইসাথে, সন্দেহ নেই এমন খবরও আসছে যে— বাংলাদেশি মুসলমানরা হিন্দুদের ঘরবাড়ি ও মন্দির পাহারা দিচ্ছে, তাই সমস্ত খারাপ খবরের সময়ও কিছুটা ভালো খবরও রয়েছে।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণে আশার আলো দেখেছেন ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এই নেতা। তিনি বলেছেন, ‘প্রফেসর ইউনূসের বিবৃতিতে সরকার সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং জনগণকে শান্ত হতে এবং সহিংসতা বন্ধ করার আহ্বান জানিয়েছে, এটি খুব ভালো লক্ষণ। যে কোনও অবিরাম সহিংসতা অবশ্যই বাংলাদেশের সমাজের সেই উপাদানগুলোর মাধ্যমেই প্ররোচিত হবে যারা ঐতিহ্যগতভাবে ভারতবিরোধী, হিন্দু বিরোধী এবং বিশৃঙ্খলার পরিস্থিতি তৈরি করার জন্য যা কিছু করা দরকার তা করবে, যা ঘোলা পানিতে মাছ ধরার সুযোগ দিতে পারে। তবে আপাতত, আমি বিশ্বাস করি না এমন কোনও কর্তৃপক্ষ আছে যারা এই পরিস্থিতি অব্যাহত রাখতে চায়।’
উল্লেখ্য, চাকরির কোটা নিয়ে কয়েক সপ্তাহব্যাপী বিক্ষোভে ৪০০ জনেরও বেশি লোক নিহত হওয়ার পর গত সোমবার ৭৬ বছর বয়সী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাকে ৪৫ মিনিটের আলটিমেটাম দেওয়ার পর তিনি ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে চলে যান।
সেখান থেকে সম্ভবত যুক্তরাজ্যে আশ্রয় নিতে তিনি লন্ডনে যেতে পারেন বলে শোনা যাচ্ছে।
তবে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় না দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে যুক্তরাজ্য। যুক্তরাজ্যের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানিয়েছেন, তাদের যে অভিবাসন আইন রয়েছে; সেখানে কোনো ব্যক্তির যুক্তরাজ্যে ভ্রমণ করে এসে রাজনৈতিক বা সাধারণ আশ্রয় নেওয়ার বিধান নেই।
এছাড়া কোটাবিরোধী আন্দোলন ঘিরে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়া শেখ হাসিনার ভিসা বাতিল করেছে যুক্তরাষ্ট্র। মঙ্গলবার দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিসা যুক্তরাষ্ট্র বাতিল করেছে বলে নিশ্চিত করেছে।