বিরতির পর টানা তিন দিনের কর্মসূচি নিয়ে ফের মাঠে নামছে বিএনপি। এর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার পতনের দুদিন পর ৭ আগস্ট ঢাকায় সমাবেশ করেছিল দলটি। এবার কর্মসূচি দিয়েছে যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদল ও কৃষক দলও। শেখ হাসিনা কর্তৃক গণহত্যার বিচার এবং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে তিন দিনের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। আজ বুধবার থেকে শুরু হওয়া কর্মসূচি সারা দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে পালিত হবে। কর্মসূচি সর্বাত্মকভাবে সফল করতে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কর্মসূচি পালনে আওয়ামী লীগের কেউ বাধা দিলে শক্তভাবে প্রতিহত করবেন বিএনপির নেতাকর্মীরা। এ ক্ষেত্রে দলটির নেতাকর্মীরা আওয়ামী লীগকে মাঠে দাঁড়াতে দেবেন না। সম্প্রতি বিএনপির দায়িত্বশীল পর্যায়ের নেতাদের বৈঠকে এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে।
বিএনপির নেতাকর্মীরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরু হলে ছাত্র-জনতার তুমুল বিক্ষোভ এবং আন্তর্জাতিক প্রবল চাপে জাতিকে অন্ধকারে রেখেই ৫ আগস্ট গোপনে দেশ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এজন্য সন্তোষ প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সমন্বয়কসহ সর্বস্তরের ছাত্র-জনতাকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানায় বিএনপি। এরপর ৭ আগস্ট ঢাকার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করে দলটি। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ৮ আগস্ট অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। গত সোমবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে মতবিনিময় করে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী কালবেলাকে বলেন, ১৬-১৭ বছর ভয়ের রাজত্বে ছিলাম। আমাদের অনেক সাথি, বন্ধু শহীদ হয়েছেন। দেশকে অস্থিতিশীল করতে একটি চক্র ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। আমরা জানি চক্রান্তকারীরা কারা, দেশের সবাই তাদের চেনেন। তিনি বলেন, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে গণহত্যা এবং হাসিনাসহ তার খুনি দোসরদের বিচারের দাবিতে বিএনপি ও অন্য সংগঠনগুলো সর্বাত্মকভাবে সারা দেশে কর্মসূচি পালনে রাজপথে থাকবে।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কয়েকজন নেতা কালবেলাকে জানান, ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতায় এসেই বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করে আওয়ামী লীগ। মূলত ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতাহীন হলে বিরোধীমতের ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে। বাধ্য হয়ে বিএনপির অনেক নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা দিয়ে নির্যাতন শুরু হয়। এর পর থেকেই বাসাবাড়িতে থাকতে পারেননি দলটির হাজার হাজার নেতাকর্মী। এভাবে টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠন করে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। ফলে বিপুল জনসমর্থন থাকার পরও পুলিশ এবং আওয়ামী লীগের যৌথ আক্রমণে দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে পড়ে বিএনপি।
দলটির দপ্তর সূত্র জানায়, এই লম্বা সময়ে বিএনপি নেতাকর্মীরা হামলা-মামলায় আরও বিপর্যস্ত হয়ে যান। বিশেষ করে মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে কেন্দ্র পর্যায়ের সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে। ছয় শতাধিক নেতাকর্মীকে গুম করা হয়েছে। এতকিছুর পর সময় সুযোগ বুঝে রাজপথের আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের একদফা দাবিতে ২০২২ সাল থেকে লাগাতার আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। ৫৫টি রাজনৈতিক দল যুগপৎভাবে একই কর্মসূচি পালন করে। ২০২২ সালে সারা দেশে বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশ, তারুণ্যের সমাবেশ, পদযাত্রাসহ অনেক শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচি তারা নির্বিঘ্নে পালন করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ সরকার, পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতিমাত্রায় বল প্রয়োগ করে। সর্বশেষ চলতি বছরের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন এবং তা ঠেকাতে সারা দেশে লাগাতার কর্মসূচি পালন করে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলগুলো। এই সময়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রায় ২৭ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শেখ হাসিনা ও তার সরকারের নির্দেশে সারা দেশে পাঁচ শতাধিক ছাত্রজনতাকে হত্যা করা হয়েছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স কালবেলাকে বলেন, প্রায় ১৭ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ গুম, খুন, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির মাধ্যমে দেশকে অকার্যকর ও গণতন্ত্রহীন করে ফেলে। কিন্তু তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। ছাত্রজনতার স্বতঃস্ফূর্ত গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। স্বৈরাচারের দোসসরা এখনো দেশকে নিয়ে চক্রান্ত করছে। তারা অসংখ্য ছাত্রজনতাকে হত্যা করেও ক্ষ্যান্ত হয়নি। এ অবস্থায় দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি চুপ করে থাকতে পারে না। আমরা ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা কর্তৃক ছাত্রজনতাকে গণহত্যা এবং তার দোসরদের বিচারের দাবিতে সারা দেশে মিছিল-সমাবেশসহ শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকব। এ বিষয়ে আমরা জাতিসংঘের মাধ্যমেও স্বচ্ছ তদন্ত চেয়েছি। কোনো চক্রান্তকারীকে ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, আমরা প্রতিশোধ-প্রতিহিংসার রাজনীতিতে বিশ্বাসী নই। কেউ পায়ে পাড়া দিলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিহত করা হবে।
বিএনপির চেয়ারপারসনস ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজরি কমিটির বিশেষ সহকারী বদরুল আলম চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর ওপর কী ধরনের আচরণ করেছে, তা দেশবাসী জানে। বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে অন্যায়ভাবে জেলে নিয়েছিল। তাকে বিদেশে সুচিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। অথচ ওয়ান ইলেভেনের সরকারের আমলে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নামেও মামলা হয়েছিল। কিন্তু হাসিনা ক্ষমতায় এসেই নিজের সব মামলা প্রত্যাহার করেন। অন্যদিকে, বিএনপিসহ বিরোধী দল ও মতের ওপর অকথ্য নির্যাতন-নিপীড়ন শুরু করেন। আমাদের অসংখ্য নেতাকর্মীকে খুন ও গুম করা হয়েছে। গায়েবি মামলায় কারাগারে দিনের পর দিন রেখে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে। এসব ঘটনা কী আমরা ভুলে গেছি? সুতরাং স্বৈরাচার আওয়ামী লীগকে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না।
আজ থেকে তিন দিনের কর্মসূচি: গতকাল মঙ্গলবার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা কতৃর্ক ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালিয়ে গণহত্যা এবং হাসিনাসহ তার খুনি দোসরদের বিচারের দাবিতে আজ বুধ ও আগামীকাল বৃহস্পতিবার সারা দেশে বিএনপির উদ্যোগে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জন্মদিবস উপলক্ষে তার দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা এবং সম্প্রতি ছাত্রজনতার আন্দোলনে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও আহতদের সুস্থতা কামনায় সারা দেশে দলীয় কার্যালয়ে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সব পর্যায়ের নেতাকর্মীকে এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের জন্য অনুরোধ করা হলো। এ ছাড়া যুবদলের উদ্যোগে আজ বুধবার এবং আগামীকাল সব জেলা, মহানগর, থানা-উপজেলা ও পৌর ইউনিটে বিক্ষোভ মিছিল এবং সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। একই কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে ছাত্রদলও। স্বেচ্ছাসেবক দলের উদ্যোগে আজ বুধ ও আগামীকাল বৃহস্পতিবার সব শাখায় বিক্ষোভ মিছিল এবং অবস্থান কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। খালেদা জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে তার দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা এবং সম্প্রতি ছাত্রজনতার আন্দোলনে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত ও আহতদের সুস্থতা কামনা করে সারা দেশের জেলা/মহানগর, উপজেলা/পৌরসভায় মিলাদ ও দোয়া মাহফিল কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে। কৃষকদলও তিন দিনের কর্মসূচি দিয়েছে। আজ এবং আগামীকাল সব শাখায় এবং ঢাকা মহানগরীর সব ওয়ার্ডে বিক্ষোভ মিছিল-সমাবেশ হবে।