সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং পরে এক দাবির আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পাঁচ জন ভিআইপি আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। রাজধানীর নিউমার্কেট ও পল্টন থানার পৃথক দুটি হত্যা মামলায় তাদের গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেওয়া হয়। এর মধ্যে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, সাবেক ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু এবং সাবেক তথ্য ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া নিউমার্কেট থানার একটি মামলায় সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও এনটিএমসির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকে আট দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্র জানায়, মামলাগুলো এখনও থানা পুলিশের কাছেই তদন্তাধীন। তবে ভিআইপি আসামি হিসেবে তাদের মিন্টো রোডের গোয়েন্দা কার্যালয়ে রাখা হয়েছে। সেখানেই তদন্ত কর্মকর্তাসহ ডিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গ্রেফতারের পর থেকেই বেশিরভাগ সময় কান্নাকাটি করছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। ইন্টারনেট শাটডাউনের বিষয়েও তিনি তার দায় অস্বীকার করেছেন। তার ভাষ্য, প্রতিমন্ত্রী হলেও ইন্টারনেট বন্ধ করার ক্ষেত্রে তার একক কোনও সিদ্ধান্ত ছিল না।
জিজ্ঞাসাবাদে পলক জানিয়েছেন, গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান ও এনটিএমসির মহাপরিচালক সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসানের নির্দেশনা মেনে তিনি ইন্টারনেট শাটডাউনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এছাড়া ইন্টারনেট শাটডাউনের ক্ষেত্রে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সায় ছিল।
জিজ্ঞাসাবাদকারী সূত্রের দাবি, ভিআইপি আসামিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভেঙে পড়েছেন জুনাইদ আহমেদ পলক। এত দ্রুত সরকারের পতন হতে পারে, তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। যদিও একদিন আগে স্ত্রী-সন্তানদের বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়ার কথাও তিনি স্বীকার করেছেন। পলকের ভাষ্য, চাইলে তিনিও দেশ ছেড়ে পালাতে পারতেন। তবে শেখ হাসিনার সঙ্গে ‘বেঈমানি করা হবে’ বলে তিনি যাননি।
সূত্র আরও জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগের বিষয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবি করেছেন। আনিসুল হকের দাবি, কোটা সংস্কার আন্দোলনের পুরো বিষয়টি তিনি প্রায় নিয়ন্ত্রণে এনেছিলেন। কিন্তু সদ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল পুলিশকে দিয়ে বল প্রয়োগ করে আন্দোলন দমানোর কারণে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি ভেস্তে যায়। এছাড়া তিনি অতি-উৎসাহী কিছু পুলিশ কর্মকর্তাদের ওপরও দায় চাপিয়েছেন। তার দাবি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্বিচারে গুলি চালানোটা উচিত হয়নি। এতে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আসার বিপরীতে আরও বেশি তীব্র আকার ধারণ করেছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, বিগত সরকারের বেসরকারি বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে তাদের কোনও ভূমিকা ছিল না বলে দাবি করেছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে গুলি করার নির্দেশনা দেওয়ার তারা কোনও অথরিটি নন বলে দাবি করেছেন। আর ডেপুটি স্পিকার হওয়ার পর রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না বলেও দাবি করেছেন শামসুল হক টুকু।
ভিআইপি আসামিদের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় এ প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে কোনও কর্মকর্তা মন্তব্য করতে চাননি। তবে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, আসামিদের সবাইকে অন্যান্য সাধারণ আসামিদের মতোই ডিবির গারদখানায় রাখা হয়েছে। তাদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা, ওষুধ ও খাবার দেওয়া হচ্ছে।
গত ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পাপোশের দোকানের কর্মচারী শাহজাহান আলীকে হত্যার অভিযোগে তার মা আয়শা বেগম বাদি হয়ে নিউমার্কেট থানায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় গত ১৩ আগস্ট পুরানো ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে আনিসুল হক ও সালমান এফ রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। একই মামলায় ১৫ আগস্ট রাতে খিলক্ষেত এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয় সাবেক মেজর জেনারেল ও এনটিএমসির মহাপরিচালক জিয়াউল আহসানকে।
এছাড়া গত ১৯ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর পল্টন থানা এলাকায় গুলিতে নিহত হন রিকশাচালক কামাল মিয়া (৩৯)। ওই ঘটনায় রাজধানীর পল্টন থানায় অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীদের আসামি করে ২০ জুলাই একটি হত্যা মামলা করেন নিহতের স্ত্রী ফাতেমা খাতুন। ওই মামলায় গত ১৪ আগস্ট গ্রেফতার করা হয় শামসুল হক টুকু, জুনাইদ আহমেদ পলক ও ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকতকে।