বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঐতিহাসিক ৯ দফা নিয়ে নানান বিভ্রান্তিকর দাবির মুখে অবশেষে মুখ খুলেছেন নয় দফার ঘোষক ও সমম্বয়ক আব্দুল কাদের। ছাত্রশিবির ৯ দফা প্রণয়নে কী ভূমিকা রেখেছিল, সেটি পরিষ্কার করেছেন তিনি।
ফেসবুক পোস্টে কাদের বলেন, কোটা সংস্কারকে উদ্দেশ্য করে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। কিন্তু সরকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করলে আন্দোলন ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় নয় দফার অবতারণা হয়। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু ১৬ তারিখ মঙ্গলবার আবু সাঈদসহ ৬ জন যখন শহীদ হয়, সেদিন রাত ১২টায় সামনের সারির সমন্বয়করা মিলে আমরা একটা অনলাইন মিটিং করি। মিটিংয়ে প্রথম এজেন্ডাই ছিল, আজ যে ছয়জন শহীদ হলো, এই ছয়টা লাশের বিনিময় শুধু কোটা সংস্কার কি না? তখন সবাই বলে ওঠে, ছয়টা লাশের বিনিময় শুধু কোটা সংস্কার হতে পারে না। পরবর্তী সময়ে দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা করা হয়। এ আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিসহ আরও কিছু দাবি দাওয়া উঠে আসে।
তিনি লেখেন, বলে রাখা ভালো, আমরা এতদিন ‘বাংলা ব্লকেড’ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পেশসহ নানান সফট এবং হার্ড কর্মসূচি নিয়ে মাঠে অবস্থান করছিলাম। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে একেবারে নির্বিকার-নির্লিপ্ত মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। আলাপ-আলোচনার ধারধারে নাই সরকার। কেবল হাইকোর্টের কাঁধে বন্দুক রেখে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়ে যায়, ৬ জন শহীদ হয়, সেদিনই সরকার আলোচনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়। আমাদের বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দিতে থাকে আলোচনায় বসার জন্য। কিন্ত আমরা আলোচনার আহ্বানকে বরাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করি। যদিও ভেতর-বাহির থেকে আলোচনায় বসার নানা রকম চাপ আসছিল।
‘সরকার সংলাপের আহ্বান ফরমালি জানিয়েছিল। কিন্ত তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আমাদের অবস্থান ফরমালি ক্লিয়ার করি নাই। ক্লিয়ার করার সুযোগও পাই নাই। বুধবার গায়েবানা জানাজায় ঢাবি ক্যাম্পাসে পুলিশ আমাদের ওপর গুলি চালায়, আমিসহ কয়েকজন আহত হই। হান্নান মাসউদ গুলিবিদ্ধ হয়। তখন থেকেই আমরা আন্দোলন পরিচালনা করে যাওয়ার স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নিয়ে গ্রেপ্তার এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। যদিও সরকারের সংলাপকে প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার রাতে আমরা কিছু দাবি দাওয়া ঠিক করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তী সময়ে সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করে যে সেই দাবিগুলো ফাইনাল করবো সে সময় পাইনি। তবে আমরা বৃহস্পতিবার মাঠের কর্মসূচি (কমপ্লিট শাটডাউন) দিয়ে নিজেদের অবস্থান ক্লিয়ার করেছিলাম।’
আব্দুল কাদের আরও বলেন, বৃহস্পতিবার আমি আর আসিফ ভাই একবাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে চলে যাই। সেদিন ১৮ তারিখ রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। আমরাও কর্মসূচি চলমান রাখতে, গ্রেপ্তার এড়াতে বারবার জায়গা পরিবর্তন করে বেড়াচ্ছি। কারও সঙ্গে তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। আন্দোলনের শুরুতেই নাহিদ ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে এক লোকের সঙ্গে মিট করায়। এবং পরবর্তী সময়ে আন্দোলনের পারপাসে একাধিকবার সে লোকের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। পরবর্তী সময়ে জানতে পারি তিনি ঢাবি শিবিরের ছাত্রআন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কিন্ত তখনো শিবিরের সভাপতি এবং সেক্রেটারির সঙ্গে যোগাযোগ হয় নাই।
‘শুক্রবার যাত্রাবাড়ী এলাকায় যখন আন্দোলন করছিলাম তখন শিবিরের ঢাবি সেক্রেটারি ফরহাদ ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বললো, ‘আন্দোলনরত কয়েকজন সমন্বয়ক সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে। এত এত শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করতেছে তারা। আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিছু দাবি-দাওয়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, মানুষের সঙ্গে বেইমানি করা যাবে না।’ আমি সম্মতি জানাই। আমাদের আগেই অবস্থান ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া মঙ্গলবার রাতের মিটিংয়ে ঠিক করা কিছু দাবি দাওয়া আমার মাথায় আছে।’
ওই সময়ের পরিস্থিতি বর্ণনা করে কাদের বলেন, আন্দোলন চালিয়ে নেওয়ার মতো মাঠে কোনো সিনিয়র নাই। আসিফ-নাহিদ ভাইকে গুম করে রেখেছে। আমি সাত-পাঁচ না ভেবে রিস্ক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেদিন জুমার নামাজের পর পরই যাত্রাবাড়ীতে কয়কজন শহীদ হয়। সবগুলো আমার চোখের সামনেই ঘটছে। মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলছে, এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাছাড়া দীর্ঘদিন জেল-জুলুম, হামলা-মামলার শিকার হয়ে হাসিনার এমন অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছি; মাথা নত করি নাই। আমার পরিণতি কী হবে, সেটা কল্পনা করি নাই। চোখের সামনে মানুষ মেরে ফেলছে, মানুষের কথা চিন্তা করে নিজের জীবনের কথা ভাবার সময় পাই নাই। গত ৪/৫ বছর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই আমাদের দৃঢ়তা ধরে রাখার শিক্ষাই দিয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরার সিদ্ধান্ত নিই।
ঢাবি শিবির সেক্রেটারির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাইহোক। কিছুক্ষণ বাদে শিবিরের সেক্রেটারি আমাকে আবারও ফোন দিলো। বলতেছে, ‘কিছু দাবি দাওয়া খসড়া আকারে করছি, তোমার সঙ্গে আলোচনা করি।’ আমাদেরও যেহেতু আগেই আলোচনা হয়েছিল অনেকগুলো দাবির ব্যাপারে সেগুলো তখন উনার সঙ্গে আলোচনা করে সমন্বিতভাবে তৈরি হয় ৯ দফা। তিনি একে একে কিছু দাবি বললেন। যেগুলা খুব কমন দাবি দাওয়া। যেমন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, ছাত্র হত্যার সঙ্গে জড়িত পুলিশ প্রশাসনকে বরখাস্ত, সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা, ভিসির পদত্যাগ। যেগুলো ৬ জন শহীদ হওয়ার পরে মঙ্গলবার রাতের বৈঠকের আলোচনাতেই আমরা ভেবেছিলাম। এছাড়া মানুষজনও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছিল।
‘শেষের দিকে গিয়ে শিবিরের সেক্রেটারি একটা দাবি অ্যাড করলো। ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে’। এটা আমি মানি নাই। দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা হইলো। পরে আমি বললাম, ঢালাওভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা যাবে না। এক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলতে পারেন। পরে সেটাই ঠিক হইলো, ‘লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে’। এই হইলো নয় দফা তৈরির পেছনের গল্প। তবে নয় দফা প্রচার-প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল শিবির। যেহেতু নেট নাই, গোলাগুলি-কারফিউয়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে হাউজে হাউজে পৌঁছে দিয়েছে, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা তারাই করেছে।’
কাদের বলেন, আমাকে নতুন একটা সিম এবং মোবাইল কালেক্ট করার পরামর্শ দিলো তারা। আমি স্টুডেন্ট এর বাসা থেকে সিম নিয়ে ওই নাম্বারটা নয় দফা সংবলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির সঙ্গে দিয়ে দিলাম। সেদিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে ৪-৫ কিলোমিটার দূরে হেঁটে গিয়ে পরিচিত সাংবাদিকদের ফোন দিয়ে নয় দফার বিষয়টা জানালাম। টুকটাক ছাত্ররাজনীতি করার সুবাদে ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল। তো সে রাতে তাদের অনেককে একটা একটা করে দফা বাটন ফোন দিয়ে ম্যাসেজের মাধ্যমে দাবিগুলো লিখে পাঠিয়েছি। পুরা নয়টা দাবি একসঙ্গে ম্যাসেজে পাঠানো যায় না। কাউকে আবার মুখে বলে দিয়েছি, সে লিখে নিয়েছে। কেউ আবার রেকর্ড করে নিয়েছে। কনফার্ম হওয়ার জন্য অনেকেই ফোন দিয়েছে, এটা আসলেই আমি দিয়েছি কি না। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলোকেও ফোন দিয়ে কনফার্ম করা গেছে, আমার পক্ষ থেকে এটা যাচ্ছে, আপনাকে একজন পেনড্রাইভের মাধ্যমে পৌঁছে দেবে। এভাবে চলল রাতের ১১টা পর্যন্ত।
সে সময়ের ভয়াবহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে কেন্দ্রীয় এই সমন্বয়ক বলেন, প্রতিদিন রাতে বাসা থেকে দূরে চলে যেতাম। ফোন অন করে সাংবাদিকদের সঙ্গে ২-৩ ঘণ্টা কথাবার্তা বলে, তাদের কনফার্ম করে, ফোন বন্ধ করে আবার বাসায় ফিরতাম। সিনিয়ররা গুম অবস্থায় ছিল। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না বাকিদের সঙ্গেও। এভাবেই চলতে থাকলো। আমার বাসা ছিল যাত্রাবাড়ী থানার পাশেই। গ্রেপ্তারের আতঙ্ক, তারপরও বাসায় থাকতে হতো। শুরুতেই যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। কোনো রাত মসজিদে কাটিয়েছি। কোনো রাত অর্ধেকটা বাইরে কিংবা বাসার ছাদে কাটিয়ে শেষ রাতে বাসায় ফিরেছি।
‘এইতো ঐতিহাসিক নয় দফা, আমাদের নয় দফা, ফ্যাসিস্ট হাসিনা থেকে মুক্তি লাভের সনদ।’