নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়- সাকিব আল হাসান কী এখন এই কথাটা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছেন? হয়তো পাচ্ছেন, অবশ্য ভাবলেশহীন সাকিবের সেটা টের না পাওয়ারই কথা। ক্যারিয়ারে এমন সময় তো আর কম দেখতে হয়নি সাকিবকে। এসবে অভ্যস্ত বলা চলে তাকে। যার প্রমাণ মিলে সাকিবের সবশেষ বিজ্ঞাপনী বার্তাতেই।
দেশে যখন সাকিবকে নিয়ে চলছে কঠোর আন্দোলন। সাকিবের প্রিয় প্রাঙ্গণ মিরপুরে যখন তার আসা থামাতে জড়ো হয়েছে হাজারও তরুণ। হত্যা মামলার আসামীর দেশে আসা রুখতে হাতে প্ল্যাকার্ড ও স্টেডিয়ামের দেয়াল জুড়ে যখন লেখা হয়েছে নানা কিছু; পুড়ানো হচ্ছে কুশপুত্তলিকা; তখনও নির্বিকার সাকিব।
সাকিবের টেস্ট ক্যারিয়ার ফুরোল, নটে গাছটি মুড়োল
দুবাইয়ে অবস্থানরত সাকিব বিসিবির গ্রিন সিগনালের অপেক্ষা করে শেষমেশ ক্ষান্ত হয়ে দেশে না আসার সিদ্ধান্ত জানান। তবে এর ঠিক কিছুক্ষণ পরেই আবুধাবি টি-টেন লিগের দল বাংলা টাইগার্সের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে একটি ভিডিও বার্তা পাঠান সাকিব। যেখানে তিনি বলেন, ‘আমার জীবন, আমার নিয়ম, আমার ধরন, আমার আচরণ। আমাকে ভালোবাসুন কিংবা ঘৃণা করুন, আমি পরোয়া করি না। কিন্তু আমার সঙ্গে খেলবেন না।’
এটা যে চলমান ঘটনাপ্রবাহকে কেন্দ্র করেই নির্মিত সেটা বুঝা যায় সাকিবের ভিডিও বার্তায় দেওয়া কথাগুলোতেই। যেখানে ফুটে উঠেছে দেশে আসতে না পারায় কতটা বিরক্ত তিনি।
সাকিববিরোধী স্লোগানে উত্তাল মিরপুর
কিন্তু প্রশ্ন হলো-ক্রিকেটে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে সবচেয়ে বেশি সুনাম এনে দেওয়া সাকিব কেন খেলতে পারলেন না তার শেষ ম্যাচটি? কেন তার শেষ ইচ্ছের মূল্য দিল না বিসিবি? শেষ বেলায় সাকিব কি তার প্রিয় প্রাঙ্গণ মিরপুরে ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট ম্যাচটা খেলতে পারতেন না। ক্রিকেটে যেই সুনাম তিনি এনে দিয়েছেন তাতে কি তার এইটুকু চাওয়াকে মূল্য দেওয়া যেত না? খুব বেশি কি চেয়েছিলেন সাকিব?
যে কারণে ক্ষমা চেয়েও দেশে ফেরা হচ্ছে না সাকিবের
এই প্রশ্নের উত্তরগুলো দু’ভাবে দেওয়া যায়। আবেগে ভাসলে সহজেই বলা যায়, হ্যাঁ, অবশ্যই সাকিবকে সম্মানের সঙ্গে বিদায় জানানো উচিত বিসিবি ও পুরো দেশের। কেননা, বিশ্ব মঞ্চে বাংলাদেশকে সম্মান এনে দিয়েছেন তিনি। জিতিয়েছেন বহু ম্যাচ। বাংলাদেশকে অনেকেই চিনে সাকিবের কারণে। তার মতো, এত লম্বা সময় তিন ফরম্যাটেই শীর্ষ অলরাউন্ডারের স্থান ধরে রাখতে পারেনি আর কেউ।
তবে উত্তরটা ভিন্ন হবে যখন শুনবেন এই সাকিব, ক্রিকেটে নিজের সুনাম কাজে লাগিয়ে মানুষের আবেগ নিয়ে খেলেছেন। ক্রিকেটে জড়িত থাকা অবস্থায়, মাঠের চেয়ে বিজ্ঞাপনের বাজার ধরতে বেশি সময় দিয়েছেন। জড়িয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। ক্রিকেটের পাশাপাশি ব্যবস্থায় সিদ্ধহস্ত হতে চেয়েছেন। তবে এসন তিনি করতেই পারেন। বারণ নেই। তবে সেখানেও প্রতারণা করেছেন তিনি। শেয়ার বাজার কারসাজিতে নাম এসেছে তার। তার প্রতিষ্ঠানের নামে অভিযোগ আছে কাঁকড়া খামারে শ্রমিকদের বেতন না দেওয়ার। এছাড়াও ফিক্সিংয়ে মতো কাণ্ডে জড়িয়ে আইসিসির শাস্তিও পেতে হয়েছে তাকে।
এরপর এসব মেনে নিয়েছিল মানুষ। কারণ, যখনই বিতর্কিত হয়েছেন সাকিব। তখনই মাঠে ফিরে পারফর্ম করে সব ভুলিয়ে দিয়েছেন তিনি। যেই দর্শক খানিক আগে তাকে গালি দিয়েছে। সেই একই দর্শক খেলা শেষে সাকিবের প্রশংসা করেছে। সাকিব এভাবেই নিজের সব বিতর্ক ভুলিয়ে দিয়েছিল ভক্তদের।
তবে এখন সেই সময় ফুরিয়েছে। সাকিব এখন আর ড্রাইভার নন, প্যাসেঞ্জার। ব্যাটে-বলে ধার কমেছে বয়স বাড়ার সঙ্গে। প্রত্যাশা মাফিক পারফর্ম যেমন করতে পারছেন না অনেকদিন। এটাও সমস্যা নয়, তবে সমস্যা হলো- ক্রিকেটকে বিদায় বলার আগেই রাজনীতিতে জড়িয়েছেন সাকিব। আর তখনই সাকিবের পাশ থেকে একটা অংশ সরে যায়।
রাজনীতিতে নবাগত সাকিব, আরও বড় ভুলটা করেছেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সমর্থন না জানিয়ে। ক্রিকেট মাঠে সাহসী ও প্রতিবাদী সাকিব, রজনীতির উদ্দেশ্য হাসিলে রইলেন চুপ করে। অথচ, দেশে চলছে তখন ভয়াবহ অবস্থা। একের পর এক মানুষ মরছে তার দলের নির্দেশে; যৌক্তিক আন্দোলনে নেমে। দেশে তার ভক্তরা তার কাছে সমর্থনের আহ্বান জানালেও তিনি তা করেননি। যেই তরুণ দর্শকদের ভালোবাসায় তিনি আজকের সাকিব আল হাসান, তা ভুলে গিয়ে বরং পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন; দেশের জন্য আপনাদের অবদান কী? দেশে যখন শিশুরা মরছে, তিনি তখন ঘুরে বেড়িয়েছেন নিজের স্ত্রী ও সন্তাদের নিয়ে। তার কাছে প্রাধান্য পেয়েছে কেবল ব্যক্তি জীবন। অন্যের জীবনের কোনো মূল্য নেই তার কাছে। কেবল নিজের রাজনৈতিক পরিচয়টাকেই বড় করে তুলে ধরেছেন তিনি।
অর্থাৎ আন্দোলনের এই সময়টাতে ক্রিকেটার সাকিব পুরোদস্তর বনে গেলেন রাজনীতিক হিসেবে। তবে মানুষের সাকিব হওয়া হলো না তার। এ নিয়ে সাকিব কী ভেবে দেখবেন কখনো? অবশ্য সেই সময় থাকলে তো তার।