একীভূতকরণের সিদ্ধান্তের কারণে কয়েকটি ব্যাংকের আমানতকারীরা আতঙ্কে ভুগছেন। এ কারণে তারা ব্যাংকে রাখা টাকা তুলে ফেলছেন। এতে শাখায় শাখায় নগদ টাকা দেওয়ার চাপ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়ছে ব্যাংক। আবার আতঙ্ক ও আস্থাহীনতার ফলে খুব বেশি নতুন আমানত পাচ্ছে না এসব ব্যাংক। এ কারণে অনেক ক্ষেত্রে শাখাগুলো গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী টাকা দিতে পারছে না। এমন খবরে আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে টাকা তোলার জন্য ছুটছেন গ্রাহক।
এমন পরিস্থিতির কারণ সম্পর্কে ব্যাংক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক একীভূতকরণসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের বেশকিছু ভুল নীতির কারণেই ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।
তাদের মতে, মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। আবার সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক নগদে ডলার বিক্রি করায় তাদের কাছে টাকা আটকে গেছে। সরকারও বাজার থেকে বিল অকশনের মাধ্যমে টাকা তুলে নিচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ আদায় না হওয়া ও খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণে তারল্য সংকট তীব্র হয়েছে। ফলে গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে গিয়ে ব্যাংক হিমশিম খাচ্ছে।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়ায় তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক যেসব ব্যাংককে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সেগুলো থেকেই টাকা তোলার চাপ বাড়ছে। এর মধ্যে গ্রাহকের হিসাবে টাকা থাকার পরও কয়েকটি ব্যাংক সেই টাকা ফেরত দিতে পারছে না। আইসিবি ইসলামী ব্যাংকের অনেক শাখায় গ্রাহকরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী টাকা ফেরত পাচ্ছেন না। আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকেও একই পরিস্থিতি দেখা গেছে।
গ্রাহকদের টাকা দিতে না পারার কারণ জানতে চাইলে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুহাম্মদ শফিক বিন আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা আগে কখনো এমন সংকটে পড়িনি। সব আমানতকারী একই সময়ে টাকা তুলতে আসছেন। যে কারণে তাদের টাকা দিতে হিমশিম খাচ্ছি। এ বছর গ্রাহকদের ৫০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে তারল্য সহায়তা চেয়েছিলাম। কিন্তু এখনো পাইনি। কারণ আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের জামানত হিসেবে কোনো তরল সম্পদ নেই। আশা করি, এ মাসের মধ্যে এই সংকট কেটে যাবে।’
এদিকে একীভূতকরণের খবরে সরকারি খাতের বেসিক ব্যাংক থেকেও টাকা তোলার হিড়িক লেগেছে। গত এক মাসে ব্যাংকটি থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন গ্রাহকরা। এ ছাড়া পদ্মা ও ন্যাশনাল ব্যাংক থেকেও টাকা তোলার হিড়িক দেখা গেছে।
ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট সম্পর্কে মন্তব্য চাওয়া হলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর কালবেলাকে বলেন, ‘মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু ভুল নীতির কারণে এই সংকট তৈরি হয়েছে। একীভূতকরণের যে উদ্যোগটি বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়েছে, সেটি অবশ্যই একটি ভালো সিদ্ধান্ত। তবে প্রয়োগের যে পদ্ধতি, সেখানে সমস্যা আছে। আগে দুর্বল ব্যাংকের
দায়-দেনার হিসাব করতে হবে। তারপর যে ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকের দায়িত্ব নেবে সে তার পরিকল্পনা জানাবে। অন্যদিকে যাদের কারণে একটি ব্যাংক দুর্বল হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব কিছু না করেই বাংলাদেশ ব্যাংক জোর করে নিজেদের মধ্যে
আলাপ-আলোচনা করে এক ব্যাংকের সঙ্গে আরেক ব্যাংকের একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে। এতে গ্রাহকের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। ফলে তারা ব্যাংক থেকে আমানত তুলে নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর তারল্য সংকট তো বাড়বেই। কারণ মূল্যস্ফীতি তো নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ফলে নতুন আমানতও আসছে না।’
তারল্য সংকট সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেসবাউল হক কালবেলাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির অংশ হিসেবে বাজার থেকে টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট তৈরি হয়েছে। এজন্য ব্যাংকগুলোকে অনেক আগে থেকেই খেলাপি ঋণ আদায় বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। যেসব ব্যাংক আদায় বাড়াতে পারছে, তাদের সমস্যা কম হচ্ছে। আর যারা আদায় করতে পারছে না, তাদেরই সমস্যা বেশি হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘তারল্য সংকট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রয়োজনীয় নীতি সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকবে।’
আইসিবি ইসলামিক ব্যাংকের সংকট বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকটির তহবিলের একটি বড় অংশ কিছু লিজিং কোম্পানির কাছে আটকে আছে, যে কারণে তারল্য সংকট দেখা দিয়েছে। সেটা উদ্ধারে চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংকের মালয়েশিয়ান শেয়ারহোল্ডারকে নতুন করে তহবিল দিতে বলা হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ব্যাংক খাতের মোট আমানত দাঁড়িয়েছে ১৬ লাখ ৭৫ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এর মধ্যে মেয়াদি আমানত বেড়েছে ১০ দশমিক ৩৭ শতাংশ এবং চলতি আমানতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এর আগের মাস ফেব্রুয়ারিতে আমানত প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। আর জানুয়ারিতে এই প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, টানা তিন মাস আমানত প্রবৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ছাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ১১ দশমিক ০৪ শতাংশে পৌঁছায়, যা ছিল বিগত ২৮ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। যদিও এর আগে, করোনা মহামারির সময়ে বৈশ্বিক মন্দায় পড়ে অর্থনৈতিক গতিমন্থরতার প্রভাবে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আমানত প্রবৃদ্ধির হার কমে গিয়েছিল।
অন্যদিকে মার্চ শেষে কারেন্সি আউট সাইড ব্যাংক বা মানুষের হাতে থাকা টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা, যা আগের মাস ফেব্রুয়ারির তুলনায় তিন হাজার ৬২১ কোটি টাকা বেশি। আর গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ দশমিক ৫৬ শতাংশ বেশি। গত বছরের মার্চ মাস শেষে মানুষের হাতে নগদ টাকা ছিল ২ লাখ ৫৪ হাজার ৬৬৮ কোটি টাকা।
একদিকে ব্যাংকগুলোতে নতুন আমানত না আসায় তারল্য সংকট বাড়ছে, অন্যদিকে আস্থাহীনতায় গ্রাহক টাকা তুলে নিচ্ছেন, যা আর ব্যাংকে আসছে না। এর ফলে ব্যাংকগুলোতে সংকট আরও তীব্র হয়েছে। এই সংকট মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে আসছে। গতকাল মঙ্গলবার বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক রেপো এবং অ্যাসিউরড লিকুইডিটি সাপোর্ট ফ্যাসিলিটির (এএলএসএফ) মাধ্যমে মোট ২২টি ব্যাংক ও ৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ১৭ হাজার ৯২ কোটি টাকা ধার দেওয়া হয়েছে।