18 C
Dhaka
Wednesday, December 11, 2024

এমপি আনার হত্যাকাণ্ড

শাহীনের সেই বাগানবাড়িতে যাতায়াত করতেন নায়িকারাও

ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহিন দীর্ঘ বছর আমেরিকা থাকলেও তার ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুরের নিজ বাগানবাড়ি স্থানীয়দের কাছে রহস্যে ঘেরা। সেখানকার সাধারণ মানুষের বিচরণ নেই বাগান বাড়ির আশ-পাশ দিয়েও। মাঝে-মধ্যে অপরিচিত আর বিভিন্ন অঞ্চলের প্রভাবশালীদের আনাগোনা বাড়িকে ঘিরে। গত ৩/৪ মাস আগেও দর্শনা থেকে ফেরার পথে এমপি আনার এই বাংলোতে এসেছিলেন। তখন দুই বন্ধু শাহিন ও আনারের মাঝে দীর্ঘ আলাপচারিতা হয়েছিল।

এছাড়াও শুধু আনার না, মাঝে-মধ্যে গাড়ি নিয়ে বাংলোতে অজ্ঞাত লোকজনকে আসা-যাওয়া করতে দেখেছে গ্রামবাসী। এই তালিকায় ঢাকাই ছবির নায়িকারাও রয়েছেন- এমনটাই জানিয়েছেন গ্রামবাসী ও প্রত্যক্ষদর্শীরা।

দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার অভিযোগ উঠলেও তা অস্বীকার করেছেন শাহীন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাকে ফাঁসানো হয়েছে।

কোটচাঁদপুর উপজেলা শহর থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে এলাঙ্গী গ্রামের নির্জন মাঠ পার হলেই চোখে পড়ে চারিদিকে কাটাতাঁরে বেড়াতে ঘেরা অনেক জায়গাজুড়ে ঘন জঙ্গল, কাছে গেলে ক্রমেই ভিন্ন পরিবেশের হাতছানি, নানা রকমের ফুল-ফলের গাছ। কয়েক বছর আগে ৩০ বিঘারও বেশি জমিতে গড়ে তোলেন এই বাংলো বাড়ি। সিসি ক্যামেরায় মোড়ানো সেখানে কাঁচে ঘেরা দ্বিতল বাড়িসহ রয়েছে বৈচিত্র্যময় টিনশেড স্থাপনা ও সুইমিংপুল। এই বাংলো নিয়ে কোটচাঁদপুরের সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা জল্পনা-কল্পনা থাকলেও বছরের পর বছর কেউ কোনোদিন মুখ খোলেনি।

তবে এখন অনেকেই বলছে বাড়িতে হুটহাট করে বিলাসবহুল কিছু গাড়ি আসা-যাওয়া করে। শাহিন যখন দেশে আসে তখন এখানেই বেশি সময় দেন। এমপি আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে অভিযুক্ত আক্তারুজ্জামান শাহিনের এই বাংলোতেই আগে প্রায়শই আসতেন তার বন্ধু আনার। নানা স্থানের ভিআইপিদের আনাগোনা থাকায় এদিকে কেউ তাকাতো না। স্থানীয় প্রশাসনও আসে না এলাকার এই বাংলো রহস্যের কাছে।

আরও পড়ুনঃ  আটক ৭৮ নাবিকের ছবি প্রকাশ করলো ভারতীয় কোস্টগার্ড

অন্যদিকে মেধাবী শিক্ষার্থী হলেও স্কুলজীবন থেকেই মাদকে তার হাতেখড়ি হয় শাহীনের। প্রথমে গাঁজা-ফেনসিডিল সেবন করতেন। আস্তে আস্তে মাদকের কেনাবেচা শুরু করেন। এরপর মাদক ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি বেড়ে গেলে স্থানীয় বখাটে পোলাপান, মাস্তানসহ বিভিন্ন পেশার লোক নিয়ে গড়ে তোলেন মাদকের সিন্ডিকেট, শুরু হয় নানা ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড ও বাড়তে থাকে অপরাধের শাখা-প্রশাখা। নেমে পড়েন চোরাকারবারী, ব্ল্যাকমেইলিং, স্বর্ণ পাচার আর হুন্ডির ব্যবসা। ভারত সীমান্তবর্তী ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুরসহ সীমান্ত এলাকায় তার এক সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে। এসবের মাঝেও মেধাবী শাহিন কোটচাঁদপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং কেএমএইজ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমি থেকে লেখাপড়া শেষে মেরিন ইঞ্জিনিয়র হিসেবে জাহাজে চাকরি নেন। চাকরির দুই বছরের মাথায় ওপি-ওয়ান ভিসা পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পান। যুক্তরাষ্ট্রের ৩৭৯ ইস্ট সেভেন্থ স্ট্রিট ব্রুকলিন এলাকায় শাহীনের বাড়ি রয়েছে, সেখানকার নাগরিকও তিনি।

যখনই প্রবাস থেকে ফেরেন তখন বাংলোবাড়িকে ঘিরে এক ধরনের উত্তেজনা তৈরি হয়, কিছু অপরিচিত মানুষের আনাগোনা বাড়ে। কিন্তু কারা তারা, এমন প্রশ্ন করতে সাহস রাখেন না কোটচাঁদপুরের বাসিন্দারা।

আক্তারুজ্জামান শাহিনের সাম্রাজ্যে খুবই বিশ্বস্ত হিসেবে এলাকাবাসী চেনে সলেমানপুর গ্রামের ফারুক হোসেন ওরফে ভবুকে। এই ভবুর মাধ্যমেই ঝিনাইদহ-৪ (কালীগঞ্জ) আসনের এমপি আনোয়ারুল আজিম আনারের সঙ্গে পরিচয়, সখ্যতা, ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয় শাহিনের। তাদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় নানা ‘ব্যবসায়িক’ প্রসঙ্গে। নিয়মিত যাতায়ত বাড়ে দু-জনের। প্রায় ৩ দশকের সম্পর্ক তাদের।

আরও পড়ুনঃ  আজ যে কর্মসূচি পালন করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

চলতি মাসের ১২ মে তারিখে এমপি আনার ভারতে গিয়ে নিখোঁজ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে ওঠে আসে তার দীর্ঘদিনের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনের নাম। চাঞ্চল্যকর আর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের তদন্তে নেমে ভারত-বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিশ্চিত হয়, তিনিই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আনারকে পরিকল্পিতভাবে হত্যার মাস্টারমাইন্ড। তবে তা ঠান্ডা মাথায় রীতিমতো অস্বীকার করেছেন অভিযুক্ত শাহীন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে বাংলাদেশের একটি বে-সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেওয়া অডিও সাক্ষাতে সাংবাদিকদের বলেছেন, তাকে ফাঁসানো হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামের কাজী আসাদুজ্জামানের তিন ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে চতুর্থ শাহীন। তার বাবা আড়তদারি ব্যবসা এবং কৃষিকাজ করতেন। তার বড় ছেলে সহিদুজ্জামান সেলিম থাকেন কোটচাঁদপুর শহরের বাজারপাড়ার বাড়িতে। তিনি কোটচাঁদপুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র। এর আগে ভোটে দাঁড়িয়ে হারলেও এইবার মেয়র হওয়ার পেছনে ছিল শাহিনের নেপথ্য কলকাঠি। শাহিনের আরেক ভাই মনিরুজ্জামান মনির ১৯৮৮ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডেট্রয়েট শহরে থাকেন, পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। মেয়ে খুকু থাকেন কখনো কানাডায়, আবার কখনো ঢাকায়। আর ছোট ছেলে আক্তারুজ্জামান শাহীন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। আরেক মেয়ে এলিন থাকেন ঢাকায়।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, পারিবারিকভাবে তারা খুবই সম্ভ্রান্ত, ধনাঢ্য আর শিক্ষিত। পরিবারের সবাই যে যার মতো প্রতিষ্ঠিত। বাড়ি-গাড়ি রয়েছে দেশে-বিদেশে।

শাহীনের রহস্যময় বাগানবাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, বাড়ির গেট তালাবদ্ধ। ওপরে লাগানো রয়েছে দুটি সিসি ক্যামেরা। এই বাগানবাড়ির ভেতরে রয়েছে মিনি সুইমিংপুল। এটিকে রিসোর্ট হিসেবে আরো নান্দনিক করার পরিকল্পনা থাকলেও তা করেননি। স্থানীয়রা বলছে, পাশের জেলা চুয়াডাঙ্গাতে রয়েছে তার চোখ ধাঁধানো একটি রিসোর্ট। কোটচাঁদপুর উপজেলা শহরে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করলেও সেটি এখন সচল নেই। এলাঙ্গীর বাংলো বাড়ির বিষয়ে খোঁজ-খবর নিতে গেলে কাউকে পাওয়া যায়নি সেখানে। আর ভেতরে কাউকে ঢুকতেও দেওয়া হয় না।

আরও পড়ুনঃ  সাধারণ শিক্ষার্থীরা ঘরে ফিরেছে, অন্যরা পানি ঘোলা করার চেষ্টা করছে: ছাত্রলীগ

কালীগঞ্জের মোবারকগঞ্জ চিনিকল শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ও এমপি আনারের খুবই ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত শ্রমিক নেতা গোলাম রসুল সাংবাদিকদের জানান, আনার ও শাহিনের বন্ধুত্ব প্রায় ৩০ বছরের। পাশের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী গ্রামে শাহীনের ওই বাংলোয় প্রথমবার তিনি গিয়েছিলেন প্রায় ১ বছর আগে। তিন-চার মাস আগে শেষবার এমপি আনার তাকে ওই বাংলোয় নিয়ে গিয়েছিলেন। একদিন দর্শনা থেকে বাড়ি ফেরার পথে আনার তাকে বলেছিলেন, চলো বন্ধু শাহীনের সঙ্গে দেখা করে আসি। এরপর তারা দু-জন ওই বাংলোয় যান। আনার একান্তে শাহীনের সঙ্গে কথা বলেন।

রসুল বলেন, বাংলো দেখে বিস্মিত হয়েছেন, এই গ্রামের মধ্যে ভিআইপি বাংলো। যেখানে বিদেশি কুকুর, অনেক কর্মচারী, ভিআইপি আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো। এমপি তাকে বলেছিলেন, শাহিন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার, যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন। এখানে বেড়াতে এলে এই বাংলোতে অবস্থান করেন।

এলাকাবাসী বলছেন, রাতে সেখানে মদের আড্ডা আর সুন্দরী মেয়েদের নিয়ে আমোদ-প্রমোদ করা হয়। শাহীন নিজেই এলাকায় সালিশ-দরবার করতেন। কেউ বিরোধিতা করলে পুলিশ দিয়ে হয়রানি করার অভিযোগও রয়েছে। তার বিরুদ্ধে থানা-পুলিশে অভিযোগ দিত না কোনো মানুষ।

ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর থানার ওসি সৈয়দ আল মামুন বলেছেন, তিনি নিজেও শাহিনের বাগান বাড়িতে গেছেন, সেখানে সুইমিংপুল থেকে শুরু করে মাছের পুকুর, খেলার মাঠ, চা বাগান, ডুপ্লেক্স বাড়ি এবং বিদেশি কুকুর রয়েছে। সেখানে উঁচুতলার লোকেরা আসা-যাওয়া করত বলে শুনেছি।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ