শুরুটা কোরবানির ছাগল কেনা দিয়ে। তাও আবার যেনতেন ছাগল নয়, ১৫ লাখ টাকা দামের ‘জাতের ছাগল’। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের ছেলে মুশফিকুর রহমান (ইফাত) ওই ছাগলের সঙ্গে ছবি দিয়ে ভাইরাল হন। আর এতেই বাধে বিপত্তি।
এক ছাগলই যেন এলোমেলো করে দিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য মতিউর রহমানের দিনরাত। কে জানত, একটা ছাগল কেনাই কাল হবে।
যদিও ওই কর্মকর্তা ইফাতকে তার সন্তান মানতে নারাজ। তবে ইফাতের দুই মামা ও একাধিক নিকটাত্মীয় বিষয়টি একাধিক সংবাদমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে একে একে বেরিয়ে আসছে হাজার কোটি টাকা সম্পদের অজানা তথ্য। কেবল নিজেরই নয়, প্রথম ও দ্বিতীয় স্ত্রী এবং তার ছেলে-মেয়েদের বিলাসবহুল জীবনযাপনের হালচাল। এ তালিকা থেকে বাদ যায়নি শাশুড়িও।
এবার জানা গেল, ছেলে মুশফিকুর রহমান (ইফাত) ও স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবুর অনুরোধে শাশুড়িকে ১০ বছর আগে একটি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি উপহার দেন রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান। তার শ্বশুরবাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার আমিরাবাদ ইউনিয়নের সোনাপুর এলাকায়। তবে ওই বাড়িটি মিয়া বাড়ি হিসেবে চিনেন স্থানীয়রা।
ইফাত তার ছেলে নয়- বাবার এমন দাবির বিষয়ে পরিবারটির ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার কারণে মতিউর রহমান নিজের ছেলেকে অস্বীকার করছেন। ১৫ লাখের ছাগলের ছবিসহ ভাইরাল হওয়ার পর ইফাতের দামি ব্র্যান্ডের ঘড়ি, গাড়ি, আলিশান জীবনযাপনের নানা বিবরণ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। সরকারি চাকরিজীবী বাবার বেতনের টাকা দিয়ে ছেলে কীভাবে এমন ব্যয়বহুল জীবনযাপন করতে পারে, তা নিয়েও নানা প্রশ্ন উঠতে থাকে। এমন পরিস্থিতি সামাল দিতে তিনি তাৎক্ষণিক ছেলের পরিচয় এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন ওই কর্মকর্তা।
মতিউরের বানিয়ে দেওয়া বিলাসবহুল বাড়ির দেখাশোনা করা জসিম উদ্দিন জানান, দীর্ঘ ১০-১২ বছর ধরে তিনি এই বাড়ির দেখাশোনা করছেন। সর্বশেষ গত দুই মাস আগেও এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবু, ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত ও শাশুড়িকে নিয়ে বাড়ি এসেছিলেন। দু-একদিন থাকার পর আবার ঢাকায় ফিরে যান। মতিউর রহমানের শাশুড়ি বর্তমানে ঢাকায় মেয়েদের বাসায় ও বাড়িতে আসা-যাওয়ার ওপর থাকেন। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক ব্যক্তি বলেন, গত বছর কোরবানির ঈদে মতিউরের ছেলে ইফাত কোটি টাকা ব্যয় করে ১৪টি গরু-ছাগল কিনেছিলেন। এর মধ্যে আটটি গরু ও দুটি ছাগল ঢাকায় কোরবানি দিয়েছেন। অপর চারটি গরু নানাবাড়িতে নিজে এসে জবাই করে আত্মীয়-স্বজন ও গরিবদের মধ্যে বিতরণ করেন।
স্থানীয়রা বলছেন, মতিউর রহমান ও তার শ্যালক মো. নবিকের নামেও ফেনী ও সোনাগাজীতে বেশকিছু জমিজমা রয়েছে। যা তাদেরকে কিনে দিয়েছেন মতিউরের স্ত্রী শাম্মী আখতারের জেঠাতো ভাই মো. আরিফুর রহমান। ওই সম্পত্তির দেখাশোনা করেন তিনি।
এ বিষয়ে মতিউরের স্ত্রী শাম্মী আখতারের জেঠাতো ভাই মো. আরিফুর রহমান জানান, এনবিআর কর্মকর্তা মতিউর রহমান তার চাচাতো বোনের স্বামী। মুশফিকুর রহমান (ইফাত) তাদের একমাত্র সন্তান। শাম্মী আখতারের এক বোন ও এক ভাই রয়েছে। ২৫ বছর আগে মতিউরের সঙ্গে শাম্মী আখতারের বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পর শাম্মী আখতারের বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা মিল্লাত মিয়ার মৃত্যু হয়। এরপর শাম্মীর অনুরোধে মতিউর শাশুড়ি, শ্যালিকা লাভলী আক্তার ও শ্যালক মো. নকিবকে ঢাকায় নিয়ে যান। সেখানে লাভলীকে পড়ালেখা শেষে বিয়ে দেন। আর শালক মো. নবিককে বাসায় রেখে লেখাপড়া করান। সম্প্রতি নবিক চীন থেকে ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর লেখাপড়া শেষ করে দেশে ফিরে এসে ব্যবসা ও চাকরি শুরু করেন। বর্তমানে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায় নিজস্ব বাসায় থাকেন তারা।
তিনি আরও জানান, মতিউর হঠাৎ করে একটি ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ায় তিনি নিজেকে নির্দোষ ও আড়াল করতে স্ত্রী-সন্তানদের অস্বীকার করছেন। তবে এটা অচিরেই সমাধান হয়ে যাবে। অন্যথায় ডিএনএ পরীক্ষা করলে ইফাতের পিতৃপরিচয় সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়া যাবে। এ ছাড়া ফেনী ও সোনাগাজীতে মতিউর ও নকিবের পৈতৃক ছাড়া আর কোনো জমিজমা নেই। তিনি তাদের কোনো জমিজমা কিনে দেননি বলেও জানান।
সম্প্রতি উপজেলার সোনাপুর এলাকায় মিয়া বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, দৃষ্টিনন্দন ডুপ্লেক্স বাড়িটির দরজা বন্ধ। ঘরে কেউ নেই।
মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিবুর জেঠাতো ভাই ও আমিরাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এবং সোনাগাজী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আজিজুল হক হিরণ সংবাদ মাধ্যমকে জানান, এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমান তার চাচাতো বোনের স্বামী। ইফাত তাদের সন্তান। শাম্মী আখতারের ছোট ভাই ঢাকাতে ব্যবসা করেন। বিভিন্ন সময়ে মতিউর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সোনাগাজীতে শ্বশুরবাড়িতে বেড়াতে আসতেন বলেও জানিয়েছেন। তবে শাশুড়িকে মতিউরের বিলাসবহুল বাড়ি উপহারের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।