28 C
Dhaka
Friday, November 22, 2024

উগ্র ইসলামিক রাষ্ট্র প্রমাণে চলছে চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা। ইতি ঘটে হাসিনা সরকারের দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলের। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব নেন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ইউনূস সরকার দায়িত্ব নিলেও প্রশাসনের সর্বাঙ্গে দলীয়করণের ফলে নানাবিধ ষড়যন্ত্রের মুখে পড়তে হয়েছে বর্তমান সরকারকে। এর বাইরেও একটি গোষ্ঠী বাংলাদেশকে বহির্বিশ্বে উগ্র ইসলামপন্থি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চতুর্মুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। কৌশলে বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর কালো পতাকা ছাত্র-জনতার হাতে তুলে দিয়েছে গোষ্ঠীটি। আর সেটি না বুঝেই আবেগে হাতে তুলে নিয়ে মিছিল করছে ছাত্র-জনতা। এসব ছবি ও ভিডিও বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে একটি উগ্র ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করার চেষ্টা করছে ষড়যন্ত্রকারীরা। আর তা ফলাও করে প্রচার করছে বিদেশি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম।

তথ্য বলছে, ষড়যন্ত্রকারী দেশি-বিদেশি গোষ্ঠীগুলো তুরুপের তাস হিসেবে বেছে নিচ্ছে উগ্র ইসলামপন্থিদের। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা গোয়েন্দাদের একাংশ। তারাই উগ্রপন্থিদের উসকে দিচ্ছেন। বিশেষ করে সাম্প্রতিককালে হিজবুত তাহরীরের প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ নির্দিষ্ট কোনো পক্ষের পরিকল্পনা ছাড়া সম্ভব নয়। এসব মিছিল-সমাবেশের ছবি মুহূর্তেই ভাইরাল করা হচ্ছে বিভিন্ন ফেসবুক পেজ থেকে। বিদেশি কয়েকটি গণমাধ্যমেও খবর প্রকাশ করা হয়েছে।

এর মাধ্যমে তাদের উদ্দেশ্য গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে বেকায়দায় ফেলা। অন্যদিকে, দেশে আওয়ামী লীগের রাজনীতি ফের সক্রিয় করা। যে কারণে নানা দাবি নিয়ে যারাই এখন মাঠে আন্দোলনে নামছেন, তাদেরই প্রচ্ছন্ন সহায়তা দিচ্ছে গোয়েন্দা এবং পতিত সরকারের সুবিধাভোগী ওই অংশ।

জানা যায়, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই বিভিন্ন উগ্র ধর্মীয় গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নানা দাবি নিয়ে মাঠে নামা। এ ছাড়া ধর্ম এবং জাত-পাতের ধোয়া তুলেও মাঠে নামছেন অনেকে। পার্বত্য এলাকায় দীর্ঘদিনের পাহাড়ি-বাঙালি সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করে উসকে দেওয়া হয়েছে বিভেদ। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নানা ধর্মীয় স্থাপনায়ও হামলার চেষ্টা হয়েছে বারবার। উসকে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে ধর্মীয় বিভেদের। তবে সরকারের কঠোর এবং বিচক্ষণ পদক্ষেপে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে।

আরও পড়ুনঃ  অন্তর্বর্তী সরকারকে অপসারণের জন্য রাষ্ট্রপতিকে আ. লীগের আহ্বান

এরপর নতুন করে আবার ইসলাম ধর্মের আবেগকে পুঁজি করে একটি গোষ্ঠী ফায়দা নেওয়ার চেষ্টায় নামে। ভারতে বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অসম্মানের নামে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল কর্তৃক প্রতিবাদ সভা-সমাবেশ। এসব সভা-সমাবেশে একটি গোষ্ঠী কৌশলে ছাত্র-জনতার হাতে তুলে দিচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের কালো পতাকা। যার মধ্যে অন্যতম হলো ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন আইএস। এর আগে হলি আর্টিসানে জঙ্গি হামলার সময় আইএসের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি সর্বপ্রথম সামনে এসেছিল। এই সংগঠনটি আমেরিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কর্তৃক জঙ্গি সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত।

জানা গেছে, ইউনূস সরকারকে বিতর্কিত করতে একটি পক্ষ সর্বাত্মকভাবে মাঠে নেমেছে। ষড়যন্ত্রকারী এ গোষ্ঠী চেষ্টা করছে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে একটি উগ্র ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত করতে। যে কারণে তারা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর কালো পতাকা খোরাসানের কালো পতাকা হিসেবে প্রচার করে তা সাধারণ ছাত্র-জনতার হাতে তুলে দিচ্ছেন। আর সাধারণ ছাত্র-জনতা কোনো কিছু না বুঝেই তা নিয়ে মিছিল-মিটিং, সভা-শোডাউন করছে। এমনকি অনেকে তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রোফাইল ও কভার ফটোতেও এসব কালো পতাকার ছবি দিচ্ছেন। আর ধূর্ত ওই গোষ্ঠীটি এসব ছবি সংগ্রহ করে তা পশ্চিমা বিশ্বের কাছে তুলে ধরে শেখ হাসিনার পতনের পরপরই বাংলাদেশ ইসলামী উগ্রগোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে প্রমাণের চেষ্টা করছেন।

আরও পড়ুনঃ  রাসেলস ভাইপারের বিস্তারের কারণ ও রক্ষার উপায় কী কী

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ষড়যন্ত্রকারীগোষ্ঠী যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের এটা বোঝাতে সক্ষম হয় যে, হাসিনা সরকারের পতনের পরই বাংলাদেশ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর দখলে চলে গেছে, তাহলে আমেরিকা এখানে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। এমনকি পতিত হাসিনা সরকারকে পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যও উদ্যোগ নিতে পারে। এ ছাড়া পার্বত্য অঞ্চলে বেশ কিছুদিন ধরে অস্থিতিশীল করে রাখা হয়েছে। সেখানে জাতিগত বিরোধকে উসকে দিচ্ছে একটি মহল। নিরাপত্তার অজুহাতে বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুষ্ঠান কঠিন চীবর দান বাতিল ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের এ কঠিন চীবর দানোৎসব সম্পূর্ণ শান্তি-শৃঙ্খলা ও উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করতে রাঙামাটিসহ তিন পার্বত্য জেলায় সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে বলে নিশ্চয়তা দিয়েছে জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্তৃপক্ষ।

প্রায় প্রতিদিনই পাহাড়ি কয়েকটি সশস্ত্রগোষ্ঠী মহরা দিচ্ছে। লিপ্ত হচ্ছে সংঘর্ষে। চলছে হুমকি-ধমকি, চাঁদা আদায়।

তথ্য বলছে, বিদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এসব বিষয় ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। অনেকে এর পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতিও দিচ্ছেন। এর ফলে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী দেশ ইউনূস সরকারকে সহযোগিতার পরিবর্তে অসহযোগিতা করতে পারে। আবার প্রশাসনের সর্বাগ্রে আগে থেকেই হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগীরা ওত পেতে রয়েছে। তারাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। এর ফলে চরম বেকায়দায় পড়তে পারে ইউনূস সরকার।

এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন এসব জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতা দেখা গেছে। তখনো প্রতিটি ঘটনার নেপথ্যে বিদেশের নানা গোয়েন্দা সংস্থার নাম এসেছিল। সেসময় জেএমবি, আনসার উল্লাহ বাংলাটিমের মতো বিভিন্ন সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন দেশে বিভিন্ন ধরনের জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ৬৩ জেলায় একযোগে বোমা বিস্ফোরণ, রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের উৎসবে বোমা হামালার মতো ঘটনা।

আরও পড়ুনঃ  ইন্টারনেট শাটডাউনে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা : নাহিদ

হাসিনা সরকারের পতনের পরই এসব জঙ্গি সংগঠনে উত্থান প্রমাণ করে ষড়যন্ত্রকারী গোষ্ঠী মূলত শেখ হাসিনা সরকারের হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ—এটাই প্রমাণের চেষ্টা করছে। আর তারা যদি এটি প্রমাণে সফল হয়, তাহলে ব্যর্থ হবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান।

জানতে চাইলে বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ও গবেষক অনিন্দ্য মাহবুব কালবেলাকে বলেন, ‘বর্তমানে দেশে ছাত্র-জনতা যে পতাকা নিয়ে মিছিল করছে, তা মূলত খোরাসানের কালো পতাকা হিসেবে পরিচিত। ইরাক ও সিরিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস এই পতাকা নিয়ে খেলাফত দাবি করেছিল। ইরাক ও সিরিয়ার কিছু অংশ দখল করে তারা সেখানে তাদের খেলাফত চালাতে চেয়েছিল। তবে তা সফল হয়নি। হাসিনা সরকারের পতনের পর জেল থেকে বিভিন্ন জঙ্গি-সন্ত্রাসীরা বের হয়ে গেছে। তারা ফের তৎপরতা চালিয়ে তাদের আইডোলজি পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চাইতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, তবে তারা আসলে সশস্ত্র পন্থায় যায় নাকি রাজনৈকি দল গঠন করে রাজনীতি করে, সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না।

জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সুলতান মাহমুদ কালবেলাকে বলেন, ‘এটি শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন রাজনৈতিক দল গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে ক্ষমতা যায়, তখন বিভিন্ন দল, গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। তারা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে নিজেদের সুবিধা আদায় করতে চায়। বাংলাদেশেও সেটি হচ্ছে। তবে এ বিষয়টি সরকারকে অত্যন্ত কৌশলে মোকাবিলা করতে হবে।

সর্বশেষ সংবাদ
জনপ্রিয় সংবাদ