পাকিস্তানের বেলুচিস্তান প্রদেশে জাফর এক্সপ্রেস ট্রেন হাইজ্যাকের ঘটনায় উদ্ধার হওয়া যাত্রীরা ট্রেনের ভেতরে ‘কেয়ামতের দৃশ্য’ দেখার কথা বলেছেন। মঙ্গলবার বেলুচ লিবারেশন আর্মি (বিএলএ) নামের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী কোয়েটা থেকে পেশাওয়ারগামী ট্রেনটিতে হামলা চালিয়ে কয়েক ডজন যাত্রীকে জিম্মি করে। ট্রেনের চালকসহ বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন।
উদ্ধার হওয়া যাত্রী ইশাক নুর বিবিসিকে বলেন, গোলাগুলির সময় আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ রেখে অপেক্ষা করছিলাম, কী ঘটবে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তিনি জানান, হামলার সময় ট্রেনে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে তার একটি শিশু সিট থেকে পড়ে যায়। তিনি ও তার স্ত্রী প্রত্যেকে একটি করে শিশুকে আগলে রেখেছিলেন গুলিবর্ষণের সময়।
মুহাম্মদ আশরাফ নামে আরেক যাত্রী বলেন, ‘যাত্রীদের মধ্যে প্রচণ্ড ভয় কাজ করছিল। মনে হচ্ছিলো কেয়ামতের দৃশ্য।’ তিনি জানান, ট্রেন থেকে নামার পর প্রায় চার ঘণ্টা হেঁটে পরের স্টেশনে পৌঁছান তারা। দুর্বল যাত্রীদের কাঁধে করে বহন করতে হয়েছে অনেককে।
ট্রেনের তৃতীয় কোচে থাকা মুশতাক মুহাম্মদ বলেন, ‘আক্রমণকারীরা বেলুচি ভাষায় কথা বলছিল। তাদের নেতা বারবার সতর্ক করছিলেন, যেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ওপর বিশেষ নজর রাখা হয়।’
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বিএলএ বেলুচিস্তানের স্থানীয় বাসিন্দা, নারী, শিশু ও বয়স্ক যাত্রীদের ছেড়ে দেয়। ইশাক নুর জানান, তিনি বেলুচিস্তানের তুরবাত শহরের বাসিন্দা এবং তার সঙ্গে শিশু ও নারী থাকায় তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে এখনও কতজন যাত্রী জিম্মি রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়।
উদ্ধার অভিযান চলছে
পাকিস্তানি সেনা সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত ১৫৫ জন যাত্রীকে উদ্ধার করা হয়েছে এবং ২৭ জন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। তবে এই তথ্য স্বাধীনভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী হেলিকপ্টার ও বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করেছে।
বিএলএ সতর্ক করে বলেছে, জিম্মিদের উদ্ধারের চেষ্টা করলে ‘গুরুতর পরিণতি’ হবে। উদ্ধার হওয়া এক ডজনের বেশি যাত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
বিএলএর দাবি ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বিএলএ দাবি করেছে, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বেলুচ রাজনৈতিক বন্দি, কর্মী ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের মুক্তি না দিলে জিম্মিদের হত্যা করা হবে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ এবং যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ বিএলএকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
পাকিস্তান মানবাধিকার কমিশন এক বিবৃতিতে বলেছে, তারা এই ট্রেন হাইজ্যাক নিয়ে ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’। তারা বেলুচিস্তানের নাগরিকদের সমস্যা সমাধানে একটি শান্তিপূর্ণ, রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসও এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে অবশিষ্ট যাত্রীদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে বলেছেন।
দীর্ঘদিনের সংঘাত
বিএলএ দশক ধরে বেলুচিস্তানের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। তারা পুলিশ স্টেশন, রেললাইন ও মহাসড়কে হামলা চালিয়ে আসছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে বেলুচিস্তানে গণঅপহরণ, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ রয়েছে, যা তারা অস্বীকার করে আসছে।
এই ঘটনায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পাশাপাশি পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এখনও উদ্ধার অভিযান চলমান থাকলেও পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল ও উত্তেজনাপূর্ণ রয়ে গেছে।